ধবধবে সাদা টি-শার্ট। কাছের মানুষগুলোর লেখায় ভরে গেছে। লেখালেখির লগ্ন এসেছে আজ। কেউ একজন লিখেছে, ‘তোর জন্য একটা ছেলে আজও ভীষণ একা’। বিদায়বেলা সেটা দেখে একা থাকার আর কি উপায় আছে! এই হচ্ছে র্যাগ ডে।
Advertisement
ক্যাম্পাসে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি- এভাবে পার হয় জীবনের সব থেকে সেরা দিনগুলো। কখন যে সময় চলে যায়, কেউ টেরই পায় না। চারটি বছর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুং করে বেজে ওঠে বিদায়ের ঘণ্টা। শিক্ষাজীবনের সেই মধুময় দিনগুলো বিদায়ী শিক্ষার্থীর পিছু ডাকে। আর মধুময় দিনগুলোর স্মৃতি হৃদয়ের ফ্রেমে বেঁধে রাখতে, স্মরণীয় করে রাখতে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে, স্লোগানে, রঙে-রূপে এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে র্যাগ ডে পালন করে শিক্ষার্থীরা।
র্যাগ ডে একটি ইংরেজি প্রবাদ। যার বাংলা অর্থ- ‘পড়ালেখা শেষের হৈচৈপূর্ণ দিন।’ ঘটা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের এ বিদায়ী অনুষ্ঠান পালন করেন নাচ-গান আর হাসি-তামাশার মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে র্যাগ ডে কি কোনো আনন্দের দিন, নাকি বেদনার?
নিজেদের মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ভর্তি হয়েছিলাম চার বছর আগে। এক এক করে ৪টি বছর পার করে দিলাম এবং শেষ করে ফেললাম ক্লাসের পাঠ। এই চার বছরে ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত মজার স্মৃতি, আনন্দ-বেদনার বিভিন্ন ঘটনা।
Advertisement
স্নাতক পাস করার পর ক্লাসের বিভিন্নজন বিভিন্ন বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়বে। ফলে আর কোনোদিন একসঙ্গে ক্লাস, মজা করা হয়ে উঠবে না। তাই স্নাতক পাস করার পর ক্লাসের সবাই মিলে মেতে ওঠে পাঠ সমাপনী উৎসব তথা র্যাগ ডে নামক মহানন্দে।
এভাবেই চার বছরের বিভিন্ন স্মৃতির কথা বলছিল বাকৃবির মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ৪৪তম ব্যাচের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা। সাধারণত স্নাতক পর্যায়ে ক্লাস শেষের দিনে হয়ে থাকে র্যাগ ডে। র্যাগ ডে পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার আর্থিক সাহায্য দেন না। তাই সবার চাঁদা দিয়েই পালন করা হয় এ মহোৎসব।
আনন্দ, উচ্ছ্বাস, রঙে, রূপে এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে র্যাগ ডের আনন্দে মেতে উঠেছিল মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ৪৪ ব্যাচের ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। স্মৃতিবিজড়িত ক্যাম্পাস মমতাময়ী মায়ের মতো আপন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে। এদিনে চোখের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বর্ণাঢ্য ও স্মৃতিময় ঘটনাগুলো ভেসে ওঠে। ক্যাম্পাস যেন ছেয়ে যায় উৎসবমুখর পরিবেশে। উৎসবকে সম্পন্ন করতে শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া। নানা রঙের আল্পনায় সাজিয়ে তোলে অনুষদ ভবন, ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
শেষ ক্লাসে কেক কাটা দিয়ে শুরু হয় র্যাগ ডে উদযাপন কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের গায়ে থাকে র্যাগ ডের স্লোগান সম্বলিত টি-শার্ট। যেখানে সবাই লিখছে মনের না বলা কথা। কেউ দুষ্টুমির ছলে রং দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে বন্ধুর মুখ, কেউ বা হৈ-হুল্লোড়, রং ছোড়াছুড়ি, বাদ্যযন্ত্রের তালে নাচ, গান, আড্ডায় মেতে ওঠে। কেউ আবার ব্যস্ত স্মরণীয় এসব দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে।
Advertisement
তিনদিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রং খেলা, সাইক্লিং, ফ্লাসমুভ, ট্রাকে করে পুরো ক্যাম্পাস ঘোরা, নৌকা ভ্রমণ, ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি, রিকশায় পুরো ক্যাম্পাস ভ্রমণসহ বার-বি-কিউ পার্টির আয়োজন করা হয়। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস জীবনের নানান স্মৃতিচারণ করে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
রোহানি, আশিক, অনিক, রিয়াদ, জামান, সাদিকুন নাহার রিক্তা, নাদিয়া, আরিফ র্যাগ ডে নিয়ে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘টানা চার বছর একসঙ্গে একটা পরিবারের মতো ছিলাম। অনেক আনন্দ উৎসব করলেও প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে চলে যেতে হবে ভেবে খারাপ লাগছে। স্মৃতি হয়ে থাকবে ভালোবাসার বাকৃবি ক্যাম্পাস।’
শেষদিনে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ব্রহ্মপুত্র নদে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন তারা। অনুষ্ঠানের এক মুহূর্তে এসে একে অন্যকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবশেষে সবাই যেন বলছেন বিদায়, ভালো থেকো বন্ধু। ‘তোর জন্য একটা ছেলে আজও ভীষণ একা’ বলা ছেলেটিও সবশেষে অশ্রুসিক্ত চোখে নির্বাক কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘দেখা হবে বন্ধু কারণে বা অকারণে...’
এসইউ/পিআর