রান্নার সঙ্গে সম্পর্ক খাবারের, খাবারের সঙ্গে ক্ষুধার। ক্ষুধা পেলে লোকে খেতে চাইবে, খাবে। খেতে চাইলে তাকে রাঁধতে হবে- অমনটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই যুক্তি ও স্বাভাবিকতাকে খুব কৌশলে ‘একদল’ মানুষ বদলে দেবার চেষ্টা করেছে। বদলেও দিয়েছে অনেকটা। এখনও চেষ্টা চলছে আরও। যে ‘একদল’ মানুষের কথা বললাম, তারা ‘পুরুষ’। সব পুরুষেরা কিন্তু এ দলে নেই, যারা পুরুষতান্ত্রিক তারাই অমন ‘পুরুষ’।
Advertisement
রান্না জীবনের মৌলিক একটি বিষয়-বিজ্ঞান। জীবনের সঙ্গে, বেঁচে থাকার সঙ্গে এর সম্পর্ক। রান্নার সঙ্গে নারী-পুরুষের আদৌও কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে ক্ষুধার, খাবারের। অথচ রান্নার এই কাজটিকেই খুব কৌশলে পুরুষেরা মেয়েদের কাজ হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে। চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েদের কাঁধেও।
শুধু তাই নয়, যে ছেলে রান্নাঘরে যায় বা যেতে চায়, রান্না করতে পছন্দ করে তাকে ‘মেয়েলি’ বলে সতর্কও করে দিয়েছে, যাতে কোনো ছেলের ইচ্ছে থাকলেও রান্নাঘরে আর না যায়। শ্রেণি বিভেদটি স্পষ্ট ও নিশ্চিত হওয়া জরুরি ছিল, পুরুষদের কাছে। নিশ্চিত হয়েছেও। কোনো পুরুষ আর যাই হোক ‘মেয়েলি’ হতে চাইবে না নিশ্চয়ই!
খুব সহজে দুটো দল পৃথক হয়ে গেল। একদল বসে থাকল ডাইনিং টেবিলে। শার্ট-প্যান্ট পরে তথাকথিত ভদ্রলোক সেজে। অপেক্ষা করল খাবারের জন্য। কখনও পায়ের উপর পা তুলে, কখনও পা নাচিয়ে, কখনও অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে উত্তেজনা প্রকাশ করে। অন্যদল, থাকল রসুইঘরে পড়েই। তাদের জানুতে ব্যথা, গোড়ালিতে টনটনে ব্যথা নিয়ে। এই ঘটনা নিত্যদিনের। পুরুষ এই ঘটনাকে প্রাত্যহিকতায় পরিণত করেছে।
Advertisement
দুর্ঘটনাটি ঘটে গেছে নারীর জীবনে। তাকে ধারণা দেয়া হয়েছে, এটিই তার দায়িত্ব। দিনের পর দিন তাকে, তাদের এই করে যেতে হবে। নারীকে ধারণা দেয়া হয়েছে, পুরুষের যাবতীয় আরাম ও তৃপ্তি প্রদানই তার দায়িত্ব। ফলে ‘ইনজেকটেড’ এই ধারণায় সংক্রামিত হয়ে নারী, পুরুষের রসনা তৃপ্তির যাবতীয় দায়িত্ব, নিজের মহৎ এবং মহান দায়িত্ব বলে ভেবে নিয়েছে।
নারী লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার। শিকার পুরুষতান্ত্রিকতার। পুরুষতান্ত্রিকতার দীর্ঘ ছায়াতলে থেকে, দাসত্ব করে কখনও কখনও তার মধ্যে চিন্তা ও যুক্তিশীলতাও লোপ পায়। পুরুষ চায় প্রেমিকা ও সেবিকা। প্রথমে সে প্রেম দেবে, তারপর সেবা। পুরুষ নেবে দুটোই। আর দেবে না কিছুই। এই প্রকট বৈষম্য বাড়ছে ঘরে বাইরে। ফলে বাড়ছে প্রেমহীন সম্পর্ক। তথাকথিত দাম্পত্য। পারিবারিক দাসত্ব। পুরুষ নারীর স্বাধীনতা চায় না, ভয় পায়। নারীর দুর্বলতা, অধীনতাকে সে দারুণ উপভোগ করে। ফলে যে যে কাজে নারীর অর্থপ্রাপ্তি নেই, ক্লান্তি ও একঘেয়েমি আছে সেসব কাজে নারীকে ঠেলে দেয়। উৎসাহিত করে।
নারীর উপার্জনকে পুরুষ ভালোভাবে দেখে না। দেখতে চায় না। কেননা উপার্জন অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে আসবে। নারীর উপার্জনে পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, নারীদের পোশাকে ‘পকেট’ খুব কমই থাকে। ‘পকেট’ থাকে পুরুষের পোশাকে। ‘অর্থ’ এলেই সে পুরুষের অধীনতা মানবে না। কেউই মানে না। এটাই নিয়ম জগতের। ফলে বাড়িতে হাজার পদ রান্না করলেও বাইরে রান্নার মাধ্যমে উপার্জন তার অনুমতি মেলে না। বাদসাধে পুরুষ, অথচ বাইরে রান্না করে যেখানে উপার্জনের বিশাল সুযোগ রয়েছে পুরুষদেরই প্রচণ্ড ভিড় সেখানে ।
কী অদ্ভুত রাজনীতি। নারীকে নিয়ে, নারীর শ্রম ও মেধাকে নিয়ে। শ্রম বিভাজনের রাজনীতিতে মেয়েদের ভাগে সেই কাজগুলো পড়েছে, যে কাজগুলোর স্বীকৃতি থাকলেও সম্মানী নেই। শুধু রান্না নয়, ঘরদোর মোছা, কাপড় ধোয়া এই কাজগুলোও বাড়ির মেয়েরা করে বা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিদ্ধান্ত দিয়েছে পুরুষেরা। যা আরোপিত, চাপিয়ে দেয়া, বাধ্য করা সিদ্ধান্ত।
Advertisement
পুরুষেরা ভোগ করে নারীরা ভোগে। এই নিয়মকেই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ফলে নারীরা কোনো অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ ও সম্ভাবনা ছাড়াই এই কাজগুলো দিনের পর দিন করে যাচ্ছে দাসীর চেয়ে বেশি আন্তরিকতা নিয়ে। অথচ এই একই কাজ যখন বাইরে বাণিজ্যিকভাবে করার সুযোগ আসে, সেখানে মেয়েদের অনুপস্থিত করা হয়। সন্তানের, স্বামীর, সংসারের ছুতোয়। বাইরের কাজে মেয়েদের যাওয়া বারণ, এটাই নিয়ম। রাজনীতিটা এখানেই।
বাইরে কাজের স্বীকৃতি আছে, ঘরে নেই। বাইরে সম্মানী আছে, ঘরে নেই। আছে নিরন্তর দাসত্ব, পারিবারিক-পুরুষের। পুরুষেরা তা-ই টিকিয়ে রাখতে চায়। রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ঘর ঝাড় দেয়া, ঘরে কোনোটিরই সম্মানী নেই। অর্থমূল্যে বিবেচিত নয় কোনোটি। অথচ বাইরে আছে। পুরো মাত্রায় আছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেখানে কোনো নারী নেই, পুরুষেরই উপস্থিতি, আধিপত্য, পুরো মাত্রায়। সেখানে মেয়েদের যেতে দেয় না পুরুষেরা। না রাঁধতে, কাপড় ধুয়ে, না ইস্ত্রি করতে। সেখানে পুরুষের সম্মান যায় না। কেউ তখন সেই পুরুষকে ‘মেয়েলি’ বলে না। আসলে সেখানে অর্থের যোগ রয়েছে বলে।
শুধু এ শহরে নয়, দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় শহরে-হোটেল, রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে কাজ করছে পুরুষেরাই। নারীরা সেখানে অনুপস্থিত রহস্যজনকভাবে। অথচ যে নারী ঘরে রান্না করতে পারে, সে বাইরে রান্না করতে পারবে না কেন? লন্ড্রি বিজনেস করছে পুরুষেরাই। ক্যাটারিং সার্ভিস বাজারটিও পুরুষদেরই দখলে।
রান্না একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও শিল্প। শিল্প ও বিজ্ঞান নারী-পুরুষকে কখনোই কৌশলগতভাবে আলাদা করে না করে, করে সমাজ। সমাজ উৎকট পুরুষতান্ত্রিক। তার সুবিধার জন্য যা করার সে তাই করে। সুবিধার জন্যই কৌশল ও অবস্থান পরিবর্তন করে। ফলে একই ‘রান্না’, ঘরে নারীদের কাজ বলে বিবেচিত হলেও, বাইরে তা পুরোমাত্রায় পুরুষের কাজ। কেননা অর্থপ্রাপ্তির যোগ আছে।
রান্না আসলে নারী-পুরুষ সবার। কী অসাধারণ গুণেই খাদ্য উপাদানগুলো প্রত্যেকে তাদের নিজস্বতা বজায় রেখে, অন্য একটি নতুন পরিচয়ে, নতুন নামে রূপ-রস-গন্ধে ভরে ওঠে। সময় এগিয়ে গেছে। এখন আর মিথ্যে রাজনীতি দিয়ে কাউকেই বোকা বানানো, ধোঁকা দেয়া সহজ নয়। মেয়েদের ঠেকিয়ে, ঠকিয়ে অন্ধকারে রাখার দিন শেষ।
আমরা আজকের, আধুনিক পুরুষ। কূপমন্ডুকতা, বিজ্ঞানহীনতা, কুসংস্কার মানলে আমাদের চলবে কেন? কোন অজ্ঞতারই স্থান নেই আমার কাছে। জ্ঞানের সৌন্দর্য চিরকালই মুগ্ধ করে আমাকে। রান্নার জ্ঞানটিও আমার যথেষ্ট রয়েছে। উপভোগ করি রান্না করতে। হ্যাঁ, আধুনিক পুরুষইতো রান্না করবে। করবে নারীও। নারী-পুরুষ, পুরুষ-নারী উপভোগ করবে দু’জন মিলে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্ট্রার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস