আইন-আদালত

কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকারের ফাঁসির আদেশ

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কিশোরগঞ্জের সৈয়দ মো. হুসাইন ও মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে করা মামলায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

Advertisement

ট্রাইব্যুনালে দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা প্রসিকউশনের তিন ও চার নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, ৫ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু করাদণ্ড, ছয় নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের সাজা, প্রথম অভিযোগে সাত বছর এবং দুই নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।

রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে বুধবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতমতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন।

ঘোষিত রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আসামিদের সাজা কার্যকর করতে হবে।

Advertisement

সেই সঙ্গে পলাতক মো. হুসাইনকে গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতেও বলা হয়েছে।

আদালতে রায় ঘোষণার সময় প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বলসহ প্রসিকিউশনের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে আসামিদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ও আব্দুল হালিম ।

রায় ঘোষণার সময় আসামি মোসলেম প্রধানের স্ত্রী ও দুই মেয়ে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সিনিয়র সদস্য সৈয়দ হায়দার আলী, সাবেক বিচারক ঋষিবেশ সাহা, সুলতান মাহমুদ সিমন, জেয়াদ আল মালুম, মো. মোখলেসুর রহমান বাদল, আবুল কালাম ও সাবিনা ইয়াসমিন খান, তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খানও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

Advertisement

বুধবার সকাল ৯টার দিকে আসামি মোসলেম প্রধানকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এরপর রায় ঘোষণার আগে তাকে এজলাস কক্ষে তোলা হয়। অপর আসামি হুসাইন পলাতক। তার কোনো আত্মীয়স্বজনও উপস্থিত ছিলেন না। প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন।

বেলা সাড়ে ১০টার দিকে আদালত বসার পর ১১টার কিছুক্ষণ আগে কিশোরগঞ্জের দুই আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, তারা যে রায় দিতে যাচ্ছেন, তা এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

পরে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। অপর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীও রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন। সবশেষে বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাজা ও দণ্ড ঘোষণা করেন।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমরা অত্যন্ত খুশি। সফলভাবে কাজ করতে পেরেছি। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা দুটো অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, একটি আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অপর তিনটি অভিযোগে ২২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।’

একটি দিক দিয়ে এ মামলায় ‘অসাধারণ সাফল্য’ এসেছে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, এ রায়ে প্রথমবারের মত যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একাত্তরের গণধর্ষণকে আদালত ‘জেনোসাইডাল রেপ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ওই চার্জে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল ও আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। মক্কেলের সঙ্গে পরামর্শ করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’

২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি হলো উভয় ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে ২৮তম রায়। ছয় ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ৯ মে মোসলেম ও হুসাইনের বিচার কার্যক্রম শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)-সহ প্রসিকিউশনের আনা মোট ২৩ সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ করেন। অপরদিকে আসামিপক্ষ একজন সাফাই সাক্ষী তার (সাফাই সাক্ষ্য) জবানবন্দি পেশ করেছেন।

পরপর দুই দিন রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করেন। অপরদিকে আসামিপক্ষ একদিন যুক্তি পেশ করেন। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ৭ মার্চ মামলাটি রায়ের জন্য (সিএভি) অপেক্ষমান রাখেন আদালত।

এর আগে ২০১৫ সালের ৭ জুলাই দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ওই দিন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কামারহাটি গ্রাম থেকে মোসলেমকে গ্রেফতার করা হয়।

সৈয়দ মো. হুসাইন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলীর ভাই। দুই আসামির মধ্যে মোসলেম প্রধানকে গ্রেফতার করা হলেও হুসাইন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়।

এরও আগে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হুসাইনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই অভিযোগের তদন্ত চলাকালে মোসলেম প্রধানের নাম উঠে আসে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আসামি মো. হুসাইন মুক্তিযুদ্ধের আগে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির মতাদর্শ গ্রহণ করেন। ওই সময় নিকলি থানা এলাকায় ‘রাজাকার দারোগা’ হিসেবে পরিচিত হুসাইন কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক সৈয়দ মো. হাসান ওরফে হাছেন আলীর ছোটভাই।

অপর আসামি মোসলেম প্রধান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিকলি ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় তিনি ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ। মোসলেম পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

ছয় অভিযোগ

প্রথম. নিকলীর দামপাড়া গ্রাম ও নিকলী থানা ভবন, সদরের মহাশশ্মান এলাকায় একাত্তর সালের অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হোসাইনের বিরুদ্ধে ছয় নারীকে ধর্ষণ, সুধীর সুত্রধরসহ ৩৫ জনকে হত্যা ও বাদল বর্মনসহ চারজনকে নির্যাতন।

দ্বিতীয়. নিকলী বাজার ও থানা কম্পাউন্ড এলকায় হোসাইন ও মোসলেমের নেতৃত্বে একাত্তরের ২ সেপ্টম্বর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত কাশেম আলীসহ চারজনকে আটক ও নির্যাতন।

তৃতীয়. নিকলীর গুরুই গ্রামের পূর্বপাড়ায় ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ফুল মিয়াসহ ২৬ জনকে হত্যা এবং ২৫০টি বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ।

চতুর্থ. নিকলীর নানশ্রী গ্রামে একাত্তর সালের ২১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তোফাজ্জল খান জিতুসহ সাতজনকে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ হোসাইনের বিরুদ্ধে।

পঞ্চম. একাত্তর সালের ১০ অক্টোবর নিকলী সদরের পূর্বগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মালেককে তার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগ হোসাইন ও মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে।

ষষ্ঠ. ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান ও মো. সেলিমকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ রাজাকার হোসাইন কিশোরগঞ্জ পৌরসদর, প্যারাভাঙা ও শোলাকিয়ায় রিকশা দিয়ে ঘুরিয়েছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহানের মাকে তার ছেলের রক্ত দেখিয়ে বিভৎসতা প্রদর্শন করেছিলেন। 

এফএইচ/এআরএস/এমএআর/আরআইপি/জেআইএম