মতামত

মায়েদের ছুটি নেই

ভরা মিটিংয়ে বসে আছি, আমার নিজের স্টাফ মিটিং, অর্থাৎ চারপাশে যারা আছে এরা সবাই আমার গ্রুপের লোক। সপ্তাহে একবার এদের সাথে আমার কাজ নিয়ে কথা হয়। এই মিটিংটা আমি সব সময় খুব এনজয় করি, প্রতি সপ্তাহে একবার এই মিটিংয়ে আমি নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করি। সেই সাথে তরুণ প্রাণের উদ্ভাবনী শক্তি বরাবরই নতুন করে অনুপ্রেরণা দেয়।

Advertisement

যাই হোক, সফটওয়্যারের একটা জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমিও ডুবে গেছি আলোচনায়। টিং করে শব্দ হল ল্যাপটপে। মেসেঞ্জারে আমার পতিদেবতা মেসেজ করেছেন, `তামান্না, মেয়ে তো বাসায় ফোন ধরছে না?` এদেশের আইন অনুযায়ী আমার মেয়ের একা বাসায় থাকার বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু, আমি ভীতু, বাঙালি মা বিধায় এখনো পুরোপুরি সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।  কিন্তু কোন উপায় নেই। স্কুলে অনেক ছুটি, সামারে দুই মাস, শীতে দুই সপ্তাহ, স্প্রিঙে এক সপ্তাহ। আর আমার সারা বছরে গুনে গুনে তিন  সপ্তাহ ছুটি। মানুষের হাতে পায়ে ধরে ধরে এতোগুলো বছর অনেক কষ্টে কাটিয়েছি, এখন মেয়েও বিদ্রোহ করে বসেছে। ছুটি হলে নিজের বাড়ির আরামে থাকতে চায়। তাই আমার এখন ট্রেনিং ফেইজ চলছে।

সকাল থেকে বহু যুদ্ধ করে, একটা মিটিং বাসা থেকে করে ঘণ্টা দেড়েক হল অফিসে এসেছি। এক টানা মিটিং চলবে অনেকক্ষণ। এর মাঝে এই সংবাদ। মেয়ের বাবা মেয়ের মাকে সংবাদ প্রদান করে নিশ্চিন্ত। এদিকে মা বেচারি কোন  রকমে মিটিং শেষ করে (সম্ভব হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতাম)  পেটের  খিদে এবং বাথরুম চেপে (টেনশনে বাথরুমে যেতেও পারছি না), মেয়েকে মনে মনে  গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে দিলাম  দৌড়। একই সাথে চলছে ফোন। অফিসের দরজা দিয়ে যখন বের হচ্ছি  ঠিক  তখনই মেয়ে হাই তুলতে তুলতে ফোন ধরেছে `আমি তো ঘুমাচ্ছি, আমার ছুটি না।` তখন কেমন লাগে? আমার তো কখনোই  ছুটি হয় না, অফিস ছুটি হলেও এই মা চাকরি থেকে গত ঊনিশ বছরে এক সেকেন্ডের জন্যও ছুটি পাইনি।

এক্ষুনি আবার আরেক মিটিঙে দৌড়াতে হবে। দৌড়ে গেলাম ক্যাফেটেরিয়াতে খাবার কিনতে। লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি এক চাইনিজ মহিলা চোখ মুখ লাল করে (রাগে গন গন করছে) চিৎকার করে ফোনে কথা বলছে। এই মহিলা এমনিতে খুব মিষ্টি স্বভাবের। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই থাকে। চাইনিজরা এমনিতে একটু ঝগড়ার টোনে কথা বলে। কিন্তু যেভাবে সে রাগে ফোনটাকে পারলে একটা আছাড়  মারে আমার বুঝতে বাকি  থাকলো না নিশ্চয়ই বাচ্চার ছুটি বা বাচ্চা অসুস্থ, কে এখন বাচ্চাকে রাখবে সেই চিরন্তন সমস্যা। মহিলা কিছুদিন হল চাকরিতে ঢুকেছে। ভেবে আশ্বস্ত হলাম, আমি একা নই। এই লেখা যখন লিখছি, একটা মেইল পেলাম। আমার গ্রুপের এক মেয়ে মেইল করেছে, `ছেলে অসুস্থ, দুপুরে বাসা থেকে কাজ করবো।` বেঁচে থাকো মায়েরা, ছুটি ছাড়া সংসারের বিরতিহীন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে।

Advertisement

লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।

এইচআর/আরআইপি