আমরা যারা মফস্বলে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করি; তাদের ব্যস্ততাটা একটু বেশিই। কেননা আমাদের রিপোর্টিংয়ের নির্দিষ্ট কোনো বিট নেই। রাজনীতি-অর্থনীতি-অপরাধ-খেলাধুলাসহ সব ধরনের সংবাদই আমদের সংগ্রহ করতে হয়। বিশেষ করে আমরা যারা অনলাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত; তারা সার্বক্ষণিকই সংবাদের নেশায় আসক্ত থাকি! সংবাদের দিক থেকে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গুরুত্বও বিভাগীয় শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গ্যাসক্ষেত্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সারকারখানা, নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও রেলওয়ে জংশনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি সংবাদ আকারে সবার আগে ঢাকা অফিসে পাঠাতে সে কী ব্যস্ততা আমাদের!
Advertisement
তবে ব্যস্ততার ফাঁকেই ভ্রমণপিপাসু মন মাঝে-মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় দূর অজানায়। মাস দেড়েক আগে আমিসহ তিনজন সংবাদকর্মী হঠাৎ মনস্থির করি- এবার ভারত ভ্রমণে যাবো। আমার বাকি দুই ভ্রমণসঙ্গী হলেন- আরটিভির জেলা প্রতিনিধি আজিজুর রহমান পায়েল ও স্থানীয় দৈনিক সরোদ পত্রিকার প্রতিবেদক পলাশ পাল।
ভ্রমণের জন্য আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় থাকা আমাদের প্রিয় মনোজ দা’র (মনোজ কুমার চৌধুরী) শরণাপন্ন হলাম। মনোজ দা ভারতের রাষ্ট্রীয় ইউকো ব্যাংকের আগরতলা শাখার একজন কর্মকর্তা। মাঝবয়সী মনোজ দা’র মনটা এখনো তরুণ, মনোজ দা’র সঙ্গ আমাদেরকেও সতেজ করে দেয়। ভারতবর্ষের এমন কোনো রাজ্য নেই যেখানে মনোজ দা’র পায়ের ছাপ পড়েনি।
ভ্রমণের জন্য বিমান ও ট্রেন টিকিট কাটার আগে মনোজ দা আমাদের ধারণা দিলেন অল্প সময়ে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। অবশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমেই রাজস্থান রাজ্যের আজমীর শহরের জগদ্বিখ্যাত সুফি-সাধক খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি (র.) এর মাজার জিয়ারত এবং একই রাজ্যের পুশকার শহরের বিশ্ববিখ্যাত ব্রহ্মা মন্দির দর্শন করবো। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশ (ইউপি) রাজ্যের আগ্রা শহরে অবস্থিত তাজমহলসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখবো। এরপর আগ্রা শহর থেকে দিল্লি শহর ঘুরে আবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় যাবো।
Advertisement
ভ্রমণ সম্পন্ন করার জন্য ৮দিনের সময় বেঁধে দিলেন মনোজ দা। তবে খুব চিন্তা হচ্ছিল, অফিস থেকে ৮দিনের ছুটি পাবো কি না। কিছু সময়ের জন্য ছুটির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভ্রমণের জন্য বিমান ও ট্রেনের টিকিটগুলো কনফার্ম করে ফেললাম। সেইসঙ্গে অনলাইনে ঘরে বসেই রাজস্থানের আজমীর ও উত্তর প্রদেশের আগ্রায় থাকার জন্য সরকারি দুটি আবাসিক হোটেল ও নতুন দিল্লি শহরে থাকার জন্য নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের রিটায়ারিং রুম বুক করে দিলেন মনোজ দা।
২৩ মার্চ আগরতলা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। তবে এর আগেই ছুটি চেয়ে জাগো নিউজের সহকারী বার্তা সম্পাদক ও মফস্বল ডেস্কের প্রধান প্রিয় সোহাগ ভাইয়ের (মাহাবুর আলম সোহাগ) ই-মেইলে দরখাস্ত পাঠালাম। দরখাস্ত পেয়েই সোহাগ ভাই ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘আট দিনের ছুটি কেনো?’ জবাবে বললাম, ‘অনেকদিন হলো কোথাও ঘুরতে যাই না। সহকর্মীরা মিলে ভারতে ঘুরতে যাবো।’ শর্তসাপেক্ষে ছুটি মঞ্জুর করলেন সোহাগ ভাই। শর্ত ছিলো- ভ্রমণকালীন সময়ে কিছু স্টোরি পাঠাতে হবে।
২৩ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে আগরতলার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করি আমি, পায়েল ভাই ও পলাশ ভাই। আইসিপিতে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ মিটিয়ে দুপুরে আগরতলায় প্রবেশ করি আমরা। মনোজ দা আগেই বলে রেখেছিলেন, আগরতলা ঢুকেই যেন আমাদের সবার ডলারগুলো এক্সচেঞ্জ করে নেই। আমরাও দাদার কথামতো আমাদের সবার ডলারগুলো এক্সচেঞ্জ করে নিলাম। পরবর্তীতে মনোজ দা’র সঙ্গে দেখা করে আমরা টেম্পু নিয়ে চলে গেলাম আগরতলা বিমানবন্দরে। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে (ভারতীয় সময়) ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ছিল আমাদের। দুপুর দুইটার কিছু সময় আগে বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। প্রথমেই ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিলাম। এরপর সিকিউরিটি চেকিং শেষে বিমানে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এর ফাঁকে ফেসবুকে মেসেজ করে জাগো নিউজের প্রধান বার্তা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন ভাই (মহিউদ্দিন সরকার) বললেন, ‘সঞ্চয় শুধু ঘুরলে হবে না, স্টোরিও পাঠাতে হবে’।
বিকেল ৪টার দিকে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত বিমান ছেড়ে গেল আসামের গৌহাটির উদ্দেশ্যে। বিমানে উঠেই পায়েল ভাই ও পলাশ ভাই আনন্দে উদ্বেলিত। তাদের দু’জনেরই এটি ছিল প্রথম বিমান ভ্রমণ। কৌতুহলী পলাশ ভাই হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী বিমানগুলো কী দেখতে একই রকম?’ আধাঘণ্টা পর আমাদের বিমান ল্যান্ড করলো আসামের গৌহাটির ‘লোকপ্রিয় গোপিনাথ বরদলৈ’ বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আমাদের নতুন দিল্লিগামী ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের পরবর্তী ফ্লাইট ছিল রাত ৮টা ৫ মিনিটে। যেহেতু আগরতলা বিমানবন্দর থেকেই গৌহাটি থেকে দিল্লি যাবার জন্য বোর্ডিং পাস আমরা নিয়ে রেখেছিলাম। তাই ভাবলাম, বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে একটু ঘুরে আসি।
Advertisement
মনোজ দা’র কথামতো বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বিমানবন্দর থেকে বের হলাম গৌহাটি শহর দেখতে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল পায়েল ভাই ও পলাশ ভাইয়ের ছবি তোলা প্রতিযোগিতা। ছবি তোলার পর হালকা নাস্তা শেষে সন্ধ্যা ছয়টার পর আমরা আবারও ঢুকে পড়লাম বিমানবন্দরে। তবে আমাদের ফ্লাইটের আরো দুই ঘণ্টা সময় বাকি ছিল। হঠাৎ মাথায় এলো- এ সময়ে একটা স্টোরি তো লেখাই যায়। বিমানবন্দরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম স্টোরি লিখতে। পায়েল ভাই আর পলাশ ভাইয়ের প্রথম বিমান ভ্রমণ আর তাদের কৌতুহলী মন নিয়েই লিখলাম প্রথম স্টোরি। অল্প সময়ের মধ্যেই লেখা শেষ করে ফেললাম। এরপর মুঠোফোন থেকে স্টোরির জন্য কয়েকটা ছবি ল্যাপটপে ঢুকিয়ে সেগুলো এডিট করে নিলাম।
অফিসে স্টোরি পাঠিয়ে সোহাগ ভাইকে ফেসবুকে ম্যাসেজ করলাম। কিন্তু সোহাগ ভাই তখন অফলাইনে থাকায় আমাদের কান্ট্রি ডেস্কের সহ-সম্পাদক আরাফাত ভাইয়ের (আরাফাত আলী রাজু) সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করে স্টোরি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। আরাফাত ভাই আমাকে বললেন, ‘জাগো নিউজের ভ্রমণ ডেস্কের প্রধান সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাই আগামীকাল (২৪ মার্চ) নিউজটি ছাড়বেন।’ আরাফাত ভাইয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে চলে গেলাম সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য। সিকিউরিটি চেকিং শেষে বিমানে উঠে বসলাম। এরই মধ্যে মনোজ দা ফোন করে জানতে চাইলেন, বিমান ছেড়েছে কি না, আমরা কিছু খেয়েছি কি না। অবশেষে রাত ১১টার দিকে নতুন দিল্লির ইন্ধিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছলো আমাদের বিমান। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে প্রি-পেইড ট্যাক্সিতে চড়ে নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে গেলাম। সেখানে আমাদের রাত্রিযাপনের জন্য রিটায়ারিং রুম বুক করা ছিল।
২৪ মার্চ সকাল ৬টা ৫ মিনিটে আজমীর-শতাব্দী ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম আজমীরের উদ্দেশ্যে। ট্রেন থেকেই আমাদের সকালের নাস্তা সরবরাহ করা হয়। ঘণ্টা সাতেকের জার্নি শেষে দুপুর ১টার দিকে আমরা পৌঁছলাম আজমীর রেলওয়ে জংশনে। আজমীর শহরে ঢুকতেই প্রচণ্ড গরমে গা পুড়ে যাওয়ার অবস্থা! যাই হোক, স্টেশনের পাশেই একটি মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে টেম্পু নিয়ে চলে গেলাম আজমীর শহরে থাকা রাজস্থান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড পরিচালিত হোটেল খাদিমে। হোটেলের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে অনলাইনে রুম বুকিংয়ের কাগজ দেখিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেলাম আমাদের রুমে। ফ্রেশ হয়ে বিকেলে আমি, পায়েল ভাই ও পলাশ ভাই গেলাম খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজারে। মাজার জিয়ারতের পর মাজার প্রাঙ্গণে কিছুটা সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় আবারও হোটেলে ফিরে গেলাম।
২৫ মার্চ খুব সকালে আমি আর পায়েল ভাই আবারও গেলাম খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজারে। মাজার জিয়ারতের পর সেখান থেকে বেরিয়ে ছোট মাইক্রোবাসে চেপে বসলাম তারাগড় পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। তারাগড় পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে এক অলির মাজার। শহরের সমতল সড়ক অতিক্রম করে ধীরগতিতে মাইক্রোবাসটি আকা-বাঁকা পাহাড়ি সড়কে উঠলো। আধাঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল তারাগড় পাহাড়ে উঠতে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আমাদের সব আরোহীর হাতে মাইক্রোবাস চালক গাড়ির নম্বর লেখা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ গুজে দিয়ে বলে দিলেন আধাঘণ্টার মধ্যে যেন ফিরে আসি।
আমরা সবাই অলির মাজার জিয়ারত শেষে পাহাড়ের চূড়া থেকে ঐতিহাসিক আনা সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। কেউ কেউ আবার সেখানে উটের উপর চড়ে ছবিও তুলেছেন। অবশ্য আমিও উটে চড়ে তলোয়ার হাতে নিয়ে ছবি তুলেছি। আধাঘণ্টা পর আমাদের মাইক্রোবাস আবারও যাত্রা শুরু করল খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজারের উদ্দেশ্যে। তবে আমরা দু’জন মাজারে না গিয়ে আজমীর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে নেমে পড়লাম। এরপর সেখান থেকে টেম্পু নিয়ে চলে গেলাম হোটেল খাদিমে।
হোটেল খাদিমের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে একটি ট্যাক্সিক্যাব রিজার্ভ করে রওনা হলাম রাজস্থান রাজ্যের আরেক শহর পুশকারে। সেখানে আমরা তিনজনই উটে চড়ে ঘুরলাম ঘণ্টাখানেক। এরপর চলে গেলাম বিশ্ববিখ্যাত ব্রহ্মা মন্দিরে। মন্দির দর্শনের পর আশেপাশের মার্কেটগুলো ঘুরে সন্ধ্যায় আবারও আজমীর শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। শহরে ঢুকে আজমীর রেলওয়ে জংশনে গিয়ে আমাদের জন্য বুকিং করে রাখা স্টেশনের রিটায়ারিং রুমের চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম স্টোরি লিখতে। আজমীরের নয়নাভিরাম আনা সাগর নিয়ে একটি স্টোরি লিখলাম।
চলবে-
এসইউ/পিআর