মতামত

যুদ্ধজয়ী প্রথম সরকার

ইতিহাসের পথ ধরে চলতে চলতে আমরা দেখি, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক পাঞ্জাবি নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে সামরিক শাসকগণ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা অবহেলার পাশাপাশি নির্যাতন, নিপীড়নের খড়গ তুলে দেয় আর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে শুরু করে। কখনো প্রতিরোধ কখনো বা প্রতিহত করার মাধ্যমে।এ সীমাহীন অন্যায়ের জবাব দিতে শুরু করে এ বাংলার জনগণ।

Advertisement

সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে কোনরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর অতর্কিত হামলার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি জান্তা হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রথমে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এ বাংলার একেবারে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাই। মুষ্টিমেয় কিছু রাজাকার, আলবদর, আলশামসের নেতৃত্বে কিছু পথভ্রষ্ট বাঙালি ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে দেয়া ভাষণের পরে তাঁদের আর নতুন করে কোন আহ্বানের প্রয়োজন হয়নি, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন তাঁরা।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ‘তোমাদের যা কিছু আছে’ তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের আপামর জনতা। রাজনীতিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর বীর যোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সব শ্রেণি পেশার মানুষ সেদিন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন, স্বেচ্ছায় সামিল হয়েছিলেন এই ত্যাগের মিছিলে। শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে কে ছিলেন না সে যুদ্ধের ময়দানে? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তাই জনযুদ্ধের রুপ পেয়েছিল।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অতর্কিত হামলার প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ এ মার্চের প্রথম প্রহরে তৎকালীন ইপিআরের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এই ধারাবাহিকতার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত সংগঠিত হয়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে।

Advertisement

ভৌগোলিক সুবিধার জন্যই এ অঞ্চলকে বেছে নেয়া তাছাড়া এটি ছিল মুক্তাঞ্চল। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান গ্রহণকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ এবং এমসিএগণ পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ পরবর্তীতে যাকে আমরা মানব নয় কেবল একজন দানব হিসেবেই দেখতে পাই সেই মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও সংসদীয় বিষয়াদি এবং কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। অত্যন্ত ছোট আকৃতির মন্ত্রিসভা ও সরকারী দপ্তরের একমাত্র প্রেরণা ছিল নেতা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন ধরে গড়ে ওঠা ভাবমূর্তিকে আরও বেশি করে কাজে লাগানোর মানসে এ অস্থায়ী রাজধানীর নামও তাঁর নামে ‘মুজিবনগর’ রাখা হয়। মুজিবনগরের নামানুসারে বাংলাদেশ সরকারকে অভিহিত করা হতো ‘মুজিবনগর সরকার নামে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশের প্রথম সরকারের গুরুত্ব ছিল অসীম। এই মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বার্তা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্টপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের কথা সমগ্র পৃথিবীতে জানিয়ে দেন।১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং বাকি সবাই এক সংক্ষিপ্ত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শপথ গ্রহণ করেন।

বিপুল সংখ্যক বিদেশি অতিথি ও সাংবাদিকবৃন্দ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কালের সাক্ষী হন। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নিরাপত্তাজনিত কারণে কোলকাতার থিয়েটার রোডে অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি প্রশাসনিক এবং অন্যান্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কাজ করতো এই সরকার। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত অঞ্চল উদ্ধারে মুক্তিযুদ্ধের মহান কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে এ মুক্তিযুদ্ধ যা পরবর্তীতে জনযুদ্ধে রুপান্তরিত হয় তা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক অনন্য অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা মেটানো, অধিকৃত বাংলাদেশে প্রশাসন পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, খাদ্য রসদ সংগ্রহ, চিকিৎসাসেবা দান, পররাষ্ট্র বিষয়ক তৎপরতা সচল রাখা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এর মধ্য দিয়ে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করা সে সোনালি অধ্যায়ের কারিগর মুজিবনগর সরকার তথা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যেসব মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মী, কর্মচারী, সংশ্লিষ্ট ছিলেন এ দেশের ইতিহাসে তাঁরা কেবল স্মরণীয় নন বরং পরম পূজনীয় হয়ে থাকবেন।

Advertisement

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

এইচআর/পিআর