বিশেষ প্রতিবেদন

‘ভাই আমারে একটু সুযোগ দেন’

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আয়েশা খাতুন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে যাবেন দৈনিক বাংলা মোড়ের অফিসে। সকাল ৯টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রাবাড়ী মোড়ে। এক, দুই মিনিট করে ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বাসে ওঠা সম্ভব হয়নি আয়েশার পক্ষে।

Advertisement

একের পর এক বাস আসছে। সবগুলোতেই বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। স্বল্প সময়ের জন্য বাস থামতেই আয়েশা ছুটছেন তাতে উঠতে। এক বাস মিস করে অন্য বাসে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও পারছেন না। মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে বাসে উঠতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি।

বাসের মুখে ভিড় করা অন্য যাত্রীদের উদ্দেশ্যে আয়েশার আকুতি, ‘ভাই আমাকে একটু ওঠার সুযোগ করে দেন’। একপর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে কাছের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক কমিউনিটি পুলিশের সাহায্য চান আয়েশা।

তার কাছে আকুতি করে বলেন, ‘ভাই আমাকে একটু সুযোগ করে দেন। অফিস যেতে হবে। আপনি একটু বাসের হেলপারকে বলে আমাকে ওঠার সুযোগ করে দেন। আপনি বললে ওরা শুনবে।’

Advertisement

তবে আয়েশার এ অনুরোধ মন গলাতে পারেনি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই কমিউনিটি পুলিশকে। আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে তার সোজা-সাপ্টা জবাব, ‘আমার কিছুই করার নাই। আজ সব গাড়ি লোকাল। আর লোকাল গাড়িতে যে যেভাবে পারে পাড়াপাড়ি করে উঠবে।’

কিছুক্ষণ পরে ওই কমিউনিটি পুলিশ সদস্যকে দেখা গেল একটি বাসের চালকের কাছ থেকে টাকা নিতে। এরপর ওই বাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গলা ছেড়ে বলতে থাকেন, ‘ঠেসে ঠেসে যাত্রী তোল। লোকাল সার্ভিস লোকালের মতো চলবে। প্রতিটি জায়গায় ৫ মিনিট করে দাঁড়িয়ে থাকবি। বাসের ভেতরে একটু যেন খালি জায়গা না থাকে।’

রাজধানীতে চলাচল করা বাসগুলোতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকলেও তার বিন্দুমাত্র সুবিধা ভোগ করতে পারেন না আয়েশার মতো যাত্রীরা। বাসে নারীদের জন্য যে আসন নির্ধারিত রয়েছে তাতে বসে যাচ্ছেন পুরুষ যাত্রীরা।

আয়েশার সঙ্গে কথা বলে জনা যায়, স্বল্প বেতনের চাকরি করেন তিনি। ফলে রিকশা করে অফিসে যাওয়া তার সাধ্যের বাইরে। এ কারণে বাসে ওঠার জন্য এক ঘণ্টার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে পায়ে হেঁটেই অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার আগে বাসে উঠতে খুব একটা সমস্যা হয় না। কিন্তু সাড়ে ৮টার পর অনেক কষ্ট হয়। তাই প্রতিদিন সাড়ে ৮টার আগেই যাত্রাবাড়ী মোড়ে এসে বাসে উঠি। কিন্তু আজ বৃষ্টি হওয়ায় আসতে আসতে প্রায় ৯টা বেজে যায়। এসে দেখি অন্যদিনের তুলনায় বাস অনেক কম। যেগুলো আসছে তাতেও খুব ভিড়। পুরুষরাই দৌড়াদৌড়ি করে অনেকক্ষেত্রে উঠতে পারছেন না।’

তিনি বলেন, ‘মতিঝিল ও গুলিস্তান রুটের যেকোনো বাসে উঠতে পারলেই হতো। কিন্তু কোনো বাসেই উঠতে পারছি না। যারা যাত্রী তুলছে তাদের কাছে বলেও লাভ হচ্ছে না। কেউ সাহায্য করছে না। অথচ নারীদের সিটে পুরুষরা বসে রয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘ভাই চাকরি করে মাসে আট হাজার টাকা বেতন পাই। স্বামী আগে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অফিসে সমস্যা হওয়ায় গত পাঁচ মাস ধরে তিনি বেকার। আমার আয় দিয়েই সংসার চালাতে হয়। ঘরে সাত বছরের একটি মেয়ে আছে। মেয়ের পড়ার খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে রিকশা চড়ে অফিসে যাওয়া সম্ভব না।’

শুধু আয়েশার ক্ষেত্রেই নয়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি স্থানেই বাসে উঠতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নারীদের। অথচ তাদের জন্য প্রতিটি বাসে সংরক্ষিত আসন রয়েছে। নারী আসনে পুরুষ যাত্রী বসলে জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। উল্টো রোববার থেকে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় নারীদের ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে।

আগে সিটিং সার্ভিস গাড়িগুলোতে অনেকক্ষেত্রে নারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতে পারতেন। কিন্তু সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হচ্ছে নারীদের। বাস লোকাল চলছে- এ যুক্তি দেখিয়ে চালক-হেলপাররা নারী আসনে পুরুষদেরও বসিয়ে দিচ্ছেন।

নারী আসনে পুরুষ যাত্রী বসানোর কারণ জানতে চাইলে মিরপুর-যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচল করা ১৫ নম্বর বাসের চালক মো. আসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাস যেহেতু সিটিং না, সেহেতু যে যেখানে পারে বসবে। যারা ঠেলাঠেলি করে উঠতে পারবে তারা উঠবে। কেউ না উঠতে পারলে আমাদের কী করার আছে?’

‘আমরা তো আগে লাইনে দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠাতাম। ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া নিতাম ১৫ টাকা। সিটের অতিরিক্ত যাত্রী উঠাতাম না। কিন্তু আমরা না বেশি ভাড়া নেই, এ কারণে সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়া হলো। এখন দেখেন কী হয়? ফর্মগেট যাইতে এখন আগে মতোই ১৫ টাকা লাগবে। কিন্তু লাভ কী হবে? আগে আরামে যেতেন, এখন ঠেলাঠেলি করে যাবেন’-বলেন মো. আসলাম।

শিকড় পরিবহনের হেলপার মো. আলামিন বলেন, ‘আমরা সিটিং চালাচ্ছি না। যে যেভাবে পারছেন, উঠছেন। যাত্রীরা যেখানে নামতে চাইবেন সেখানেই নামিয়ে দেয়া হবে। লোকালের যে ভাড়া, যাত্রীদের থেকে সে ভাড়াই নেয়া হবে। যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে যেতে পারলে আমাদের সমস্যা কী?’

ট্রান্স সিলভা বাসের হেলপার আরিফুল বলেন, ‘আগে যে ভাড়া নেয়া হতো এখনো সেই ভাড়াই নেয়া হচ্ছে। ভাড়া বাড়েওনি, কমেওনি। যেভাবে গাড়ি চালাতে বলবে, আমরা সেভাবেই চালাব। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’

রাজধানীতে রোববার সকাল থেকে লোকাল হিসেবে চলাচল করছে সব বাস। কিন্তু আগের মতোই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।

এমএএস/এসআর/এমএআর/পিআর