বাঙালির প্রাণের মেলা ‘বর্ষবরণ’ এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও সার্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ ও জাতপাত নির্বিশেষে এক অদৃশ্য বন্ধনে সব মানুষকে বাঁধে এ উৎসব।
Advertisement
বাংলা বর্ষবরণ ঘিরে উৎসবে মাতে প্রতিটি মানুষ, পুরো দেশ। আয়োজন করা হয় নানা মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বর্ষবরণের আমেজ ও চেহারায় বৈচিত্র্য আসছে।বাঙালিদের কাছে দিন দিন বাড়ছে এর আবেদনও।
বর্তমানে পহেলা বৈশাখের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে শোভাযাত্রা, মেলা, এমনকি পান্তা-ইলিশও। এর মধ্যে জাতীয় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠা রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
মুঘল সম্রাট আকবরের চালু করা বাংলা সনের ক্রমবিকাশের এ পর্যায়ে এসে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন দেশের সর্বোচ্চ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা অর্জন করেছে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি।
Advertisement
তবে শুরুতে মঙ্গল শোভাযাত্রা এমন ছিল না। এমনকি বাঙালি ও বাংলা সনের ঐতিহ্য শত শত বছরের প্রাচীন হলেও শোভাযাত্রার ঐতিহ্য ও ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। তবে শুরুর মাত্র তিন দশকেই মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র।
যেভাবে শুরু মঙ্গল শোভাযাত্রাসম্রাট আকবরের বাংলা সন চালুর ৪ শতাব্দী পর বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বাংলা বর্ষবরণের প্রবর্তন শুরু। মূলত ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের হাত ধরে ঢাকায় শুরু হয় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।
পহেলা বৈশাখে সম্মিলিত সংগীতের মাধ্যমে বর্ষবরণ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৬৭ সাল থেকে। কিন্তু বাংলা সনের সঙ্গে ইংরেজি সালের দিনের পার্থক্যের কারণে সমস্যার উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গাব্দ সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাসকে ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনার পরামর্শ দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব আনে। ১৯৬৬ সালে সংস্কার প্রস্তাব করা হলেও বাংলা সনের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কমিটির প্রস্তাবনা ১৯৯৬ সালে গ্রহণ করা হয়। ওই সময় ১৪ এপ্রিলকে স্থায়ীভাবে বাংলা নববর্ষ শুরুর দিন হিসেবে ঠিক করা হয়।১৯৬৭ সালে বর্ষবরণ শুরু হলেও এতে শোভাযাত্রা যোগ হয় এরও প্রায় ২০ বছর পর। দেশে প্রথমবার মঙ্গল শোভাযাত্রা হয় যশোরে, ঢাকায় নয়। ১৯৮৬ সালে যশোরে চারুপীঠ নামে স্থানীয় এক সংগঠনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম, হিরন্ময় চন্দসহ কয়েকজন।
এর আগে এ উপমহাদেশে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আর কোনো শোভাযাত্রার ইতিহাস নেই। এর তিন বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার উদ্যোগে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রা হয়। তবে এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পায় ১৯৯৫ সালে। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতি বছর হয়ে আসছে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
Advertisement
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
বাঙালির সার্বজনীন উৎসবের প্রধান আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটিকে ‘বিশ্ব অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে ইউনেস্কো। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক এ সংস্থা গত বছরের ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এ স্বীকৃতি দেয়। সর্বশেষ বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ শোভাযাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের আদেশ নির্দেশ দেয় সরকার।
কী থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায়
১৯৮৯ সালে চারুকলার উদ্যোগে জাতীয়ভাবে আয়োজিত প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল ১০টি ছোট ছোট ঘোড়া এবং বিশাল এক হাতি। পরের বছর থেকে ক্রমেই এতে যোগ হতে থাকে বাঘ, কুমির, বানর, পেঁচা, কাকাতুয়া, ময়ূর, দোয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং আরো অনেক প্রাণীর অবয়ব। একই সঙ্গে নানা শ্রেণি ও পেশার সাধারণ মানুষ বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ পরে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়।
এছাড়া শোভাযাত্রায় থাকে ষাঁড়, পাখি, খরগোশ, পেঁচাসহ বিভিন্ন পশু-পাখির অবয়ব। সেই সঙ্গে বাঁশ-বেত-কাঠের তৈরি বিরাটাকৃতির কদাকার সরীসৃপ ও প্রাণী।
মঙ্গল শোভাযাত্রার পথিকৃতের কথা
মঙ্গল শোভাযাত্রার পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীমের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা হয়। শুরুর ভাবনা সম্পর্কে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশীয় শিল্পকলার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে তারা যশোরে গড়ে তোলেন চারুপীঠ।’
তিনি বলেন, ‘বাঙালির জীবন ছিল গুণহীন জড়তায় বন্দি। আমরা প্রাণ খুলে হাসতে জানি না। এসব কারণে ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো চারুপীঠের প্রায় ৩৫০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে চারুশিল্পের সব অনুষজ্ঞ নৃত্য, বাদ্য-সমন্বিত এক উৎসবের আয়োজন করি। তা যশোরে দারুণ সাড়া ফেলে। মানুষ বলতে থাকেন, তাদের কেন নেয়া হলো না?’
‘পরের বছর (১৯৮৬) যশোরে বড় পরিসরে সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে আমরা প্রথম সামাজিক উৎসবের আদলে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা করি। যেটি জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।’
নিজের দেখানো পথ ধরে যশোরের শোভাযাত্রার তিন বছর পর এটি হয়ে ওঠে জাতীয় অনুষ্ঠান। এ নিয়ে তিনি দারুণ আনন্দিত জানিয়ে শামীম বলেন, ‘এটা তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা, কর্মব্যস্ততা। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আনন্দের ব্যস্ততা, শিল্পের ব্যস্ততা। এর মাধ্যমে আমরা হারানো দিনগুলো তুলে ধরেছি, আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় উপস্থাপন করেছি।’
মাত্র ৩০ বছরের মাথায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি অর্জন প্রসঙ্গে নিজের ভালো লাগার কথাও জানান তিনি। বলেন, ‘এর চেয়েও বেশি খুশি হব সেদিন, যেদিন দেখব এটি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব ঐহিত্যকে তুলে ধরা হচ্ছে।’
দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শোভাযাত্রা আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সবখানে শিল্পের কর্মী গড়ে তুলতে হবে। ট্রেইনার তৈরি করতে হবে। জেলায় জেলায় ওয়ার্কশপ করে তরুণদের মধ্যে এর গুরুত্ব জাগ্রত করতে হবে।
এসআর/এমএআর/এমএস