ধর্ম

পহেলা বৈশাখে ‘সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা’

পৃথিবীতে বসবাস করে অসংখ্য ভাষা জাতি ও শ্রেণি গোষ্ঠিীর মানুষ। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হয়ে ওঠে। ‘নববর্ষ’ শব্দটির সঙ্গে বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের পরিচয় অনেক পুরনো। এ দেশে বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন খুব ঘটা করেই পালন করা হয়।

Advertisement

নির্দিষ্ট সময় ও সূর্যকে আহ্বান করতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী মানুষ চৈত্রের শেষে, বৈশাখের প্রথম প্রহরে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ তিলক-ঢোলক রাখির আর্শিবাদ লাভ এবং পান্থা-ইলিশের ভূরিভোজসহ নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ইসলামের এ আহ্বান, আর্শিবাদ ও ভূরিভোজের কোনো নির্দেশনা নেই। তবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম উপলক্ষ। প্রত্যেক ভাষার লোকেরা যদি নববর্ষ উদযাপনে আগামী জীবনের কল্যাণ কামনা ও উন্নত জীবন লাভের নবপরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে এ চাওয়া দোষণীয় নয় বরং তার এ প্রার্থনা আল্লাহ তাআলার অপার রহমতের বহিঃপ্রকাশ।

আল্লাহ তাআলা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষের উৎপত্তি ঘটিয়েছেন। বাংলা, আরবি, ইংরেজি, ফরাসিসহ অগণিত অসংখ্য নাম জানা-অজানা ভাষা ও সংস্কৃতি মানুষকে দান করেছেন। এ সব ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে ‘বাংলা’ আমাদের মাতৃভাষা আর ‘পহেলা বৈশাখ’ আমাদের নববর্ষ ও জাতীয় সংস্কৃতিক উৎসব।

Advertisement

নববর্ষ উদযাপনের নামে ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা ও অবমাননা করার যেমন কোনো সুযোগ নেই। আবার এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও ঠিক নয়। ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে যেমন ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে চলে যাওয়া ঠিক নয়। তেমনি সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোরও সুযোগ নেই বরং তা দোষণীয়।

এ কারণেই ইসলাম সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাড়াবাড়িকে সমর্থন করে না। বরং সব অনৈতিক কর্মকাণ্ডই সব সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে নিষিদ্ধ।

উপমহাদেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উদযাপনের রয়েছে আলাদা আলাদা সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলা নববর্ষ উদযাপনে রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা।

বিশ্বের বিভিণ্ন দেশে নববর্ষ উদযাপনে বছরের শেষ রাতে আতশবাজি, ঘণ্টাধ্বনি, ফল খাওয়া, কাঁচ তথা তৈজশপত্র ছুঁড়ে মারা, যৌবন হারানো ও চুল-ভ্রু সাদা হওয়ার ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে এগুলোর তেমন কোনো আয়োজন নেই।

Advertisement

তবে বাংলা ভাষী মানুষদের নিকট বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। এ পহেলা বৈশাখ যদিও বিজাতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়ায় সব বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষদের এক মঞ্চে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তোলে। সবাইকে সাম্য, সম্প্রীতি ও উদারতা শিক্ষা দেয়।

কিন্তু এ ব্যাপারে কুরআনের রয়েছে সুস্পষ্ট বর্ণনা। সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে আবির্ভাব হয়েছে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় এবং গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পার।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১৩)

কিন্তু পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন করতে গিয়ে যদি কেউ কোনো ধরণের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, এ জন্য ব্যক্তি বিশেষের কর্মকাণ্ডের জন্য পহেলা বৈশাখকে দায়ী করা ঠিক হবে না।

যেমন ধরা যাক-হিজরি নববর্ষ শুরু হয়েছে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সময়কাল থেকে শুরু করে। যদি কেউ এ হিজরি নববর্ষ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়, সে জন্য তো হিজরি নববর্ষ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান দায়ী হতে পারে না।

তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে বা অন্য কোনো আজুহাতে কোনো দেশ, সম্প্রদায় বা জাতির সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সংস্কৃতির নামে অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থনও দোষণীয় অপরাধ। কেননা সবার সংস্কৃতিই সবার কাছে অতি আপন।

উদাহরণ দেয়া যায়-মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা লম্বা আলখেল্লা ও রুমাল ব্যবহার করে, পশ্চিমা বিশ্বের লোকেরা পড়ে শর্ট পোশাক। আবার বাঙালি-বাংলাদেশীরা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি-ধূতি পরিধান করতে ভালোবাসেন। তাই কারো সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করা ঠিক নয়। তবে সংস্কৃতি যেন প্রতিটি মানুষকে শালীন পোশাক পরিধান করতে উদ্বুদ্ধ করে, নৈতিক ও মানবিক হতে সাহায্য করে; সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত।

প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ মানুষের মননে নাড়া দিয়ে যায়। পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। দুনিয়ার জীবনের কাজকর্মে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

একটু পিছনে ফিরে তাকালে বুঝা যায়-যুগ যুগ ধরে এ দেশের ক্রেতা সাধারণ ও ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখেই তাদের বিগত দিনের লেনদেনের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নেন। হালখাতা তৈরি করেন। আগামীর দিনগুলোতে হালাল জীবিকার জন্য নতুন করে ভাবেন।

নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে প্রতিটি মানুষের হালখাতা ও সুন্দর আগামীর কল্যাণের সব পরিকল্পনা ও ভাবনাই অনেক গরুত্বপূর্ণ। যা মানুষের পেছনের দুঃখ-বেদনা ভুলে আগামীর দিনগুলোকে কল্যাণ ও সুখ-শান্তিতে রাঙিয়ে নিতে পারে; নৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সে ভাবনাই সবার একান্ত কাম্য।

পরিশেষে...অনৈতিক ও বিজাতীয় কর্মকাণ্ডমুক্ত ব্যবসায়িক ও কল্যাণের কাজে বৈশাখ ও হালখাতা উদযাপনে এগিয়ে আসা ইসলাম ও সময়ের দাবি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অন্যায়, অসত্য ও অসুন্দরকে দুপায়ে দলে সত্যের পথে ও শান্তির মতে চলতে আগামী জীবনের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণই হোক পহেলা বৈশাখের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম