সাহিত্য

রক্তজবার মতো

শিমুল ওদেরকে ছেড়ে একটু দূরে সরে পড়ে।

Advertisement

জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে শিশুপার্কের ঘাসে বসে আক্তার ও যূথী শিমুলের দৌড়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তটুকু চোখ ভরে দেখতে থাকে। ফুলতোলা লাল সোয়েটারটা পরলে শিমুলকে মনে হয় রক্তজবা, আলো করা সেই রক্তজবার বয়স তিন। আক্তার মহল্লার কিন্ডারগার্টেনের মাস্টার আর যূথী কিছুই না।

অনেক দিনের ক্লান্তি এসে আক্তারের কাঁধটা যেন কিছুটা পেছনে ঠেলে দেয়। দু’হাত পেছনে ধরে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মাথা আকাশের দিকে তুলে ধরলে চোখের সামনে রমনার আকাশটা ছড়িয়ে পড়ে। আহ! কতদিন আকাশ দেখা হয়নি। শহরের তুলনামূলক উঁচু গাছগুলো এই এলাকাতে হওয়ায় এখানকার আকাশটুকু ভুবন চিলের দখলে থাকে। বাতাসে স্থির মেলে ধরা ডানায় ভর দিয়ে কেমন করে দেখে দেখে নেয় সমস্ত শহর।

আক্তার একটা চিলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তার পিছু নেয়। একসাথে এত চিল শেষ কবে দেখেছিল সে? আক্তার তবুও চিল দেখে, যূথী কি দেখে? - তুমি কি চিল দেখেই কাটাবা?মেয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে- দেখো মেয়েটা কিভাবে দোলনায় দুলছে!

Advertisement

তাই তো! একটু দূরে দোলনার মধ্যে দেখা যায় আরো কিছু শিশুদের সাথে শিমুলও দুলছে। অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে সহসা দৃষ্টিকে কম আলোয় মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়, চোখ ঝাপসা লাগে। সেই ঝাপসা চোখের ভেতর আক্তার দেখতে পায়- একটা উজ্জ্বল আলোক বিন্দুর মত একটি গাঁঢ় রক্তজবা যেন জীবনের পেন্ডুলাম হয়ে দুলছে!

পেন্ডুলাম দোলক থেকে চোখ ধীরে ধীরে নিজেদের দিকে ফিরিয়ে নিলে আক্তার দেখে যূথীর হাত; অনেক যত্ন করে কিছু ঘাসের ডগা ছিড়ে রেখেছে। যূথীর এ ঘাস ছেড়া অভ্যাস অনেক দিনের, যখন প্রেম করতো তখনও এটা দেখেছে! আক্তারের ওসব ইদানিং মনে পড়ে না, মনে পড়ার সেইসব দিন কখনও যে আস্তে আস্তে মনের ভেতর নিভে গিয়েছে- টের পাওয়া যায়নি। আজ টের পেল! যূথীর আঙুল সমেত হাত চোখের সামনে ভেসে উঠলে আক্তারের মনে পড়ে-সোনার কাঁকন ছিল না, তবুও ইমিটেশনে যূথীর হাত দুটো কেমন কলমির কচি ডগা হয়ে থাকতো! বিন্যস্ত আঙুল, রংহীন নখ; তবুও কি মনোরম! ‘কোথাও গেল সেই হাত দুটো!’ প্রশ্নটা নিজের দিকেই ছুঁড়ে দেয় আক্তার। এই আট বছরে অভাব ঘাটতে ঘাটতে কয়লার রং পেয়েছে সেই হাত। আক্তারের এইসব ভাবনার মধ্যে ছেদ ঘটিয়ে যূথী বলে ওঠে-- আমাদের আরেকটি ছেলে দরকার কি বলো? এতক্ষণ পেছনে ঠেস দেয়া হাত দু’টো খুলে এনে যূথীর কোলের উপর রেখে দিয়ে আক্তার বলে,- আমার হাত দুটো ধর তো!ঘটনার আকস্মিকতায় যূথী শিহরিত হয়। তালপুকুরের গহীন পানির অতলে কৌটোয় আটকে রাখা যূথীর হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে। মফস্বলের সেই দিনগুলোতে যেমন হত! সে কি আজকের কথা? যূথীর মনে পড়ে যায়, আক্তার সেইসব চিঠির কথা। কী সব দুর্বোধ্য কথার ভেতর দিয়ে যূথীর মনে বয়ে যেত স্বচ্ছ পাহাড়ি ছড়ার মত পানির ধারা। কি ঠাণ্ডা আর কি মনোরম! ওরকম চিঠিগুলো আক্তার লিখতো কিভাবে? ওর অক্ষরের ভেতর ওমন শীতের আবহ কিভাবে বুনে দিত সে?

বহুদিন পর আক্তারের এমন নরম গলা যূথীকে আর্দ্র করে তোলে। ছল ছল চোখে যূথীর হাতের আঙুলগুলো আক্তারের আঙুল ছোয়। গলা কাঁপে, কিছু বলতে পারে না! - না, আমাদের আরো একটি মেয়ে দরকার। শিশিরে ভেজা যূথীর মুখের উপর এক চিলতে রোদের মত কথাটা এসে ঠিকরে পড়ে। এই মুহূর্তে যূথীর খুব ইচ্ছে করছে আক্তাররের চোখে তাকাতে, কিন্তু পারে না।

একদিন যূথীরও তাকানোর মত চোখ ছিল। একদিন যূথী তাকিয়েও ছিল মফস্বলের পড়ালেখা জানা ভালো ছেলে আক্তারের দিকে। দৃষ্টিতে ছিল সম্ভাবনা, ক্ষীণ জলের ধারা যেমন অপেক্ষাকৃত বড় জলের ধারায় লীন হতে চায়, ধীরে ধীরে আক্তারের ভেতর যূথী সেভাবেই মিশে যেতে থাকে।

Advertisement

পরিবারে যূথী একমাত্র কন্যা। তার বাবা মফস্বলের ব্যবসায়ী, বাজারের বড় দোকান। তাদের সমগ্র আদর ছাপিয়ে আক্তারের ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে পরিবারজুড়ে। যূথীকে অংক পড়াতে এলে যূথীর মাও একবার চোখ ভরে দেখে নিত আক্তারের নম্রতা। হৃদয়ের আন্তঃঅভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণে কখনও কখনও খসে পড়ে সৌজন্যতার সৌধ। আক্তার পারেনি সজারুর মত বুকে ব্যথা নিয়ে মফস্বল ছাড়তে। একদিন বিকেলের ফিরতি ট্রেনে তারা চেপে বসে মহানগরের দিকে! পেছনে ফেলে যাবার মত অনেক কিছুই ছিল যূথীর, স্নেহময়ী মা, বাবা, পরিজন; আক্তারের কিছুই ছিল না।

মধুবাগের এক কামরার বাসায় যখন তারা শুধু পাতলা তোষকে ঘুমাতো তখন থেকেই যূথীর আকাশ থেকে সোহাগের তারাগুলো একে একে মাটির পৃথিবীতে নেমে এলো, ভয়ংকর বাস্তব নিয়ে। সে ঘরে পেছনে তাকানোর মত কোন জানালা ছিল না। আর আক্তারের ছিল প্রতিদিন বেরিয়ে পড়ার মত একটা দরজা। সেই দরজা দিয়ে রোজ পকেটে দুঃখ নিয়ে সে ফিরেও আসে! দীর্ঘ অভিযোজন দৌড়ে আপাতত তারা টিকে গিয়েছে। পাতলা তোষকের জায়গায় একটা লোহার খাট, তার পাশে বড় আয়নাসমেত একটা টেবিল, একটা চেয়ার, সীমান্ত প্রাচীরের মত একটা আলনা, ঘরকে ভাগ করেছে খাবার ও শোয়ার দুটি ভিন্ন অঞ্চলে।

দুপুরে গোসল সেরে আয়নায় দাঁড়ালে যূথী দেখে একটা কালো তিল, তার বা স্তনের অনেকটা উপরে, অস্পষ্ট। একসময় এটা ছিল পাকা ধান ক্ষেতের ভেতরে কালো কাকতাড়ুয়ার মত পরিষ্কার। ঢাকার দীর্ঘকালীন জলবায়ু সহ্য করে গায়ের রঙটা ধুসর হয়ে উঠলে তিলটা খুঁজে পেতে কষ্ট হয় ইদানিং। তবুও তিলটা মাঝে মাঝে অতীতের সুবাস ছড়ায়!

বলা নেই- কওয়া নেই আজ হঠাৎ আক্তারের তোড়জোড়, শিশুপার্কে যাবে। শিমুল আগে কখনও শিশুপার্কে যায়নি। অবশ্য মনমরা থাকার চেয়ে মাঝে মাঝে এসব উপলক্ষ মন্দ কী? শিমুলের বয়স তিন। নাকটা পুরোটাই পেয়েছে নানার মত।

যূথী বাবাকে দেখে না আটটি বছর। শিমুলের এই তিন বছরে যূথী বুঝে গেছে নানার জেদটা সে পুরোটাই পেয়েছে। দুপুরে স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুমে বড় গামলায় পানি জমিয়ে তাকে গোসল করায়, মাথায় পানি ঢালার সময় কিছুটা অতিরিক্ত সোহাগে শিমুলের নাকটা ডলে দিতে গেলে মনে পড়ে, আহ! কতদিন বাবাকে দেখা হয়নি!

শিমুল জন্ম নিলে গ্রামের কারো মারফত একটা সোনার চেইন পাঠিয়েছিল যূথীর বাবা। কিছুটা জেদ ও অভিমান থাকলেও চেইনটা ফেরত দেয়নি সে! গত তিন বছরে অনেকবার চেইনটা বেচতে বেচতেও বেচা হয়নি বলে এখনো ওটা শিমুলের গলায় ঝোলে। মেয়েকে প্রতিবার আদরের সময় নানার একমাত্র স্মৃতিটায় ছোঁয়া লাগলে কখনও কখনও ওটা দুলতে থাকে, পুরনো ব্যথাসহ!

- তুমি আরেকটা মেয়ে চাও কেন? যূথীর পাল্টা প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেয় না আক্তার। - তোমার বাবার মত নিঃস্ব হতে চাই না বলে!এসময় দৌড়ে শিমুল কাছে চলে আসে। পেছন থেকে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়লে আক্তার কিছুটা কাত হয়ে যূথীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। যূথী ডান হাত দিয়ে সম্ভাব্য পতনকে সামলে দেয়, বিগত আটটি বছরের মত! - মা, তুমি আরেকটু দৌড়ে আসো তো! বললে শিমুল আরেক দফা দৌড়ে দোলনার কাছে চলে যায়। সন্ধ্যার রংটা আরেকটু গাঢ় হয়ে আসে। রমনার ফিরে আসা ভরা পেট ও ভরা সুখে কাতর চড়ুইদের কিচিরমিচিরের শব্দ রাস্তার হর্ন, হকারের চিৎকার ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে।

একটু পরেই উঠতে হবে। তবে আজকের দিনটাতে আক্তার যেন কিছুটা নির্ভার। সময়টাকে ইচ্ছেমত খরচের সাহস আজ তার আছে। আজ তার টালমাটাল জীবনের একটা বিশেষ দিন, তার ঝড়-ঝাপটাময় জীবনটাতে কিছুটা চমকের উপলক্ষ্য এসেছে। কিন্ত যূথীকে চমকে দেবার সেই সুতোটার নাগাল যেন সে কিছুতেই পাচ্ছে না। যূথী ঘাসের বিছানা থেকে উঠতে উদ্যত হলে আক্তার তার হাতটা ধরে নিচের দিকে টানতে টানতে বলে,- আরেকটু বসো না!আক্তারের আজকের আচরণগুলো বড্ড বেমানান লাগছে যূথীর কাছে। শীতের সন্ধ্যাকে প্রলম্বিত করে কিছুটা অন্ধকার নিজের শাড়ির আঁচলে ঘিরে আবার বসে পড়ে। - তোমার হয়েছেটা কি আজ? যূথী বলে।আক্তার এবার কিছুটা সাহসী হয়। আক্তারের কথামত চোখ বন্ধ করলে যূথী টের পায় তার করতলে ভাঁজ করা একটা কাগজ, একটা খাম। সুখের ঠিকানায় ভরে থাকা একটা চাকরির যোগদানপত্র। স্বনামধন্য একটা দৈনিক পত্রিকায় একটি ফিচার পাতার সাব এডিটর। সারাদিন টিউশনি আর স্কুলের সামান্য চার হাজার মিলিয়ে যা হয় তার থেকে তিনগুণ বেতন!

ঘটনার আকস্মিকতায় চোখের কোণায় দ্রুত সরে যাওয়া অন্ধকার দেখতে পায় যূথী। মস্তিস্কের একপাশে দোলায়মান রক্তজবাটি ফোটার অপেক্ষায় থাকে। সেই সাথে যূথীর মনে পড়ে যায় এক চিলতে বারান্দা, তার ওপারে কিচিরমিচির চড়ুইদের নিজস্ব মালিকানায় যেকোনো একটি শীর্ণ গাছ। মেয়েটির বহুবার ধোয়ায় রং জ্বলে যাওয়া সোয়েটারের বদলে সূক্ষ্ম কারুকাজে ঠাসা নরম সুতোর চাদর। মনে পড়ে, আক্তারের সুন্দর একটা লাঞ্চবক্স ফ্রিজে, তাতে নানারকম ভর্তায় ঠাসা, ব্যাগে পুরে আক্তার চলে যাচ্ছে হাসিমুখে। মনে পড়ে, ন্যুনতম প্রসাধনীসহ ড্রেসিং টেবিল, ক্রমেই স্পপষ্ট হয়ে ওঠা তিলটা সেই আয়নায়। এভাবে কিছুক্ষণ দ্রুত ধাবমান সময়ের পাখায় ভর করে ঘুরে আসে যূথী এপার-ওপার। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হলে যূথী টের পায় একটি হাত পরম মমতায় জড়িয়ে যাচ্ছে তার পিঠে।

এই ঘোরলাগা সন্ধ্যা আরেকটু জেকে বসলে আক্তার তাকায় যূথীর দিকে। নাবিক টের পায় প্রতিক্ষিত সমতট দেখা যায় দূর নিশানায়! আক্তারের এই দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে যাবার উপায় কি? গলার কাছে দীর্ঘ দুঃসময় বেরিয়ে যেতে যেতে আবার যেন আটকে যায় যূথীর।

শিশুপার্ক পেরিয়ে রাস্তায় নামলে তিনটা রিকশা ফুলের মত পেঁচিয়ে ধরে তাদের। সাধতে থাকে! রিক্সাওয়ালাও কি জেনে গেছে তাদের মেঘমুক্ত আকাশের ঠিকানা? আগেকার মত ভাড়া নিয়ে বচসা করার মত কিছু খুঁজে পায় না আক্তার। বাড়িওয়ালার মত দাপট নিয়ে সে রিকশায় চেপে বসে। দোয়েল চত্তর দিয়ে ঘুরে যাবার কথা বললে রিকশাওয়ালা আরো দশ টাকা বেশি দাবি করলে আক্তার তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। যূথীরও আজকে আগেকার মত ‘কতগুলো টাকা বেশি চলে গেল’ বলে বিকার নেই।

রমনার আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। ততক্ষণে দাদনে তাতানো জেলেদের নৌকার তলা দিয়ে মওসুমের সারি সারি পোয়াতি ইলিশের মত মেঘনার মোহনায় ঢুকে পড়ে আক্তার, যূথী আর শিমুল।

এসইউ/জেআইএম