আমার অনেক বিবাহিত বন্ধুদের দেখেছি, যারা দাম্পত্যের মধ্যে রয়েছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছে, তাদের অনেকেরই ফেসবুক আইডি ‘সিঙ্গেল’ লেখা রয়েছে। বিবাহিত পুরুষদের এ এক বিচিত্র ও বিকৃত খেয়াল যে, তারা বিবাহিত হয়েও, দাম্পত্যের মধ্যে থেকেও, নিজেদের ‘অবিবাহিত’ ইমেজটি ধরে রাখতে চান। কেন রাখতে চান, সেটি বোধহয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, বোঝার বাকি নেই কারো, সহজেই বোঝা যায়।
Advertisement
শাকিব খান যত বড় নায়কই হন না কেন, সে সব বিকৃত মানসিকতার পুরুষদের বাইরে তিনি নন। হঠাৎ করে প্রচার মাধ্যমে অপু বিশ্বাসের লাইভে আসা, শাকিব খানের গোমর ফাঁস করা, বিয়ের খবর যেকোনো মানুষকে রীতিমতো চমকে দেয়ার মতো তো বটেই। বাংলাদেশের সব চেয়ে ব্যস্ত, জনপ্রিয়, বাজারমূল্যের দামি তারকা শাকিব খান। তিনি কী করে ৮ বছর ধরে বিয়ে করে, সন্তানের বাবা হয়ে, সে ঘটনা গোপন রাখতে পারেন তা রীতিমত বিস্ময়। বিস্ময় এ কারণে যে, বড় তারকাদের কোনো খবরই গোপন থাকে না, মিডিয়ার এই বাজারে।
অপু বিশ্বাসকে ধন্যবাদ যে, অপু সত্যটি প্রকাশ করেছেন। সত্য প্রকাশ করতেও সাহস লাগে। অপুর সেই সাহসটি আছে যে, শক্তিমান, খ্যাতিমান, অর্থবান একজন শাকিব খানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছেন। প্রতিবাদ করতে পেরেছেন অন্যায়ের, অবিচারের, যে অবিচারের শিকার তিনি গত ৮ বছর ধরে।
শাকিব খান বড় তারকা। বিয়ের খবর প্রচারিত হলে তিনি বাজার হারাবেন, দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তাই যদি হয়, সেটা যদি তিনি ভাবেন, তাহলে তিনি বিয়ে করতে গেলেন কেন? অবিবাহিত থাকলে তার অসুবিধে কোথায়? বিয়েও করবেন, কিন্তু স্ত্রীর পরিচয় দেবেন না, স্বীকার করবেন না তা কী করে হয়? শুধু তাই নয়, যে সন্তানের তিনি ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ তাকে তো স্বীকৃতি না দেয়া বা গোপন রাখা রীতিমত বিকৃত মানসিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। ‘জন্মদাতা’ ও ‘বাবা’ শব্দটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বায়োলজিক্যাল সন্তান জন্ম দিলেই ‘বাবা’ হওয়া যায় না। বাবা কোন ‘রেডিমেট টার্ম’ নয়, বাবা হয়ে উঠতে হয়, তাই শাকিবকে আব্রাহাম খান জয়ের বাবা না বলে ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ বলা ভালো।
Advertisement
অপু বিশ্বাসও বড় তারকা। জনপ্রিয় নায়িকা। শাকিব খান কেবল তার ক্যারিয়ার দেখেছেন, অপুর দেখেননি। যদি দেখতেনই তাহলে অপু বিশ্বাসকে সন্তান দিয়ে, সংসারের বোঝা একা কাঁধে দিয়ে নিজে মুক্তপাখা, অসংসারী থাকলেন কীভাবে? নাকি ভেবেছেন, ক্যারিয়ার কেবল তার, পুরুষের, নারীর থাকতে নেই।
অপুকে আরো ধন্যবাদ, তিনি গতানুগতিক নারীদের মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নেননি। স্বীকৃতি না পেয়ে, স্বামী প্রত্যাখিত হয়ে অন্য নারীরা যখন আত্মঘাতী হন, অপু বিশ্বাস সেখানে দাঁড়িয়েছেন নিজের ওপর বিশ্বাস নিয়ে।
আমাদের তারকারা বিয়ে গোপন করতে চান। চান সমাজের কারণে। সমাজই এমন ধারণা দিয়েছে যে, বিবাহিত লোকটির রোমান্টিসিজম নেই। ফলে পর্দার নায়ক বা নায়িকাকে একা থাকতে হবে। অবিবাহিত হতে হবে। অবিবাহিত নায়ক বা নায়িকাকে নিজের প্রেমিক বা প্রেমিকা ভাবতে ভালো লাগে লোকের। ফলে তারাও তাই করেন। মৌসুমী গোপন রাখেন ওমর সানির আগে তার দুটি বিয়ের ঘটনা (কাবিননামাসহ যা একসময় প্রিয়জন পত্রিকায় প্রকাশিত)। শাবনূর সন্তানসহ হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে উদয় হন। পরে জানান তিনি বিবাহিত। বিয়ের পর রিয়াজ, ফেরদৌসের মার্কেট ফ্লপ করে। বিয়ে করে অনেকেই ফ্লিম দুনিয়া থেকে এখানে বিদায় নেন।
সমাজ যদি এই মানসিকতা থেকে বের না হয়, তারকারাও পারবেন না বের হতে। কেননা, তাদেরও তো এই সমাজ ও বাজার নিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
Advertisement
লেখাটি লিখতে লিখতেই অনলাইনে, ফেসবুকে নানা খবরের লিংক ভেসে আসে। সাংবাদিক সম্মেলন করবেন, করবে না। সন্তানের দায়িত্ব নেবেন, অপুর নয়। অপু স্ত্রী, স্ত্রী নয়। পরে দেখলাম, সন্তান ও স্ত্রী হিসেবে অপু বিশ্বাসকে মেনে নিয়েছেন শাকিব খান।
শাকিব খান আসলে পুরোমাত্রায় একজন পুরুষতান্ত্রিক, সনাতন মানুষ, আধুনিক প্রগতিশীল পুরুষ নন। যিনি সহকর্মীকে বিয়ে করেছেন, সঙ্গীর ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করেননি। যিনি সন্তানও নিয়েছেন কিন্তু স্ত্রীকে বাইরে প্রেমিকা, ভেতরে সেবিকা হিসেবে রাখতেই পছন্দ করেন। স্ত্রী অপু বিশ্বাসের ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করতেও তার বাধেনি।
অপু বিশ্বাস না বললে, প্রতিবাদ না করলে, হয়তো ৮ কেন, আরো ১৮ বছর কাটিয়ে দিতে চাইতেন শাকিব নিজের ‘অবিবাহিত’ ইমেজ নিয়ে।
সন্তান আব্রাহাম ও স্ত্রী হিসেবে অপু বিশ্বাসকে তিনি যে মেনে নিয়েছেন, তা আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই ফল। পুরুষ নারীকে নির্যাতন করে। আবার তার তীব্র প্রতিবাদকে ভেতরে ভেতরে ভয়ও পায়। এই ঘটনা ফাঁসে শাকিব খান যারপরনাই বিচলিত হয়েছেন। চাননি সামাজিকভাবে তার ‘নায়ক’ ইমেজটি আরো বেশি ‘খলনায়কে’ পর্যবসিত হোক। আরো বেশি ধিক্কার আসুক। আরো বেশি ছি ছি করুক লোকে, এ ঘটনা ফাঁসে। চাননি তার ক্যারিয়ারে কফিনের শেষ পেরেকটি পড়ুক। তাই রাতভর টেলিভিশন লাইভে এলোমেলো কথা বলে সকালে মেনে নিয়েছেন সব।
একজন হিসাবি, চতুর, স্বার্থপর, নির্যাতনকারী শাকিব খানের মুখোশটা যত সুপুরুষেরই হোক, মুখটা গতানুগতিক পুরুষতন্ত্রেরই।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস