কারখানার ভেতর থেকে শব্দ আসছে। তবে মেশিনের নয়। একটু খেয়াল করলেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মানুষের পদচারণা; কারখানার মেশিন ও যন্ত্রপাতি সরানোর শব্দ।
Advertisement
যেখানে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মানুষের ঘুম ভেঙেছে মেশিনের শব্দে; সেখানে এখন যেন গভীর নীরবতা। তবে মাঝেমধ্যে সে নীরবতা ভাঙছে শ্রমিকদের হেইয়া-হেইয়া শব্দ।
গত ৬৭ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা হাজারীবাগের যে চিরায়ত রূপ, ইতিহাস; তা যেন এখন অচেনা। হাজারীবাগ এখন আর ঠিক ৬৭ বছরের চামড়া শিল্পের ইতিহাসের কথা বলছে না। এখানে এখন শুধুই বিদায়ের সুর, ভাঙনের চিহ্ন।
সোমবার রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা ঘুরে দেখা গেল এমন চিত্র।
Advertisement
আদালতের নির্দেশে ৮ ও ৯ এপ্রিল হাজারীবাগে অবস্থিত সব ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পরিবেশ অধিদফতর। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে ট্যানারির সব কাজ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সব কারখানার কাজ বন্ধ। নেই মেশিনের ঘটঘট বিরামহীন শব্দ। চারদিকে অন্ধকার। কারখানার ভেতরে চামড়ার স্তূপ। কিছু ট্যানারিতে ভরদুপুরের অন্ধকারে চলছে মেশিন সরানোর কাজ।
হাজারীবাগ ট্যানারি মোড়ের পশ্চিম দিকে আইয়ুব ব্রাদার্স ট্যানারি। কারখানার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, তাই বাইরে বসে আছেন কয়েকজন। এ প্রতিবেদককে তারা বলেন, ‘ভেতরে গিয়ে কী করবেন? অন্ধকার আর গরম।’
কিছুক্ষণ পরই শোনা গেলো ভেতর থেকে আসা শ্রমিকদের হেইয়া-হেইয়া শব্দ। মেশিন সরানোর কাজ করছেন আট/দশ শ্রমিক। একজন টর্চলাইট ধরে আছেন। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘একটু আলো দিন, নইলে মেশিন সরাই কেমনে।’
Advertisement
কারখানায় অন্ধকারে কাজ করছেন মোহাম্মদ হোসেন নামে এক শ্রমিক। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কাঁচাচামড়া ওয়েট ব্লুর পর এ মেশিনে চামড়া কাটার কাজ করা হয়। মেশিন সরানোর জন্য গ্যাস না হলেও চলে কিন্তু বিদ্যুৎ দরকার। গত তিন দিন ধরে কাজ করছি। গরমে বেশি সময় কাজ করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু মেশিন সরানোর কাজ করছি। এখান থেকে মেশিন খুলে সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে নিয়ে স্থাপন করব। এখানকার এক একটি মেশিনের ওজন ৮ থেকে ১৪ টন। অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সরকার এতদিন সময় দিল, কিন্তু এখন সরানোর সময় দিল না।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুমা ট্যানারির এক শ্রমিক বলেন, ‘কাজ করছিলাম, এমন সময় বিদ্যুতের লাইন কাটায় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। দুই দিন ধরে কোনো কাজ নেই। কয়দিন বসে বসে খাব? কে বসিয়ে খাওয়াবে? সমস্যায় পড়েছি আমরা। কী করব বুঝতেছি না!’
আরেক শ্রমিক বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে কারখানার পাশে ঘুমাতাম। তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ, পানি নেই। আমাদের কে দেখবে? মালিকরা তো গুলশান থাকে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রুমা কারখানার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্যানারি নিয়ে আসলে একটা গোলমেলে অবস্থা তৈরি হয়েছে। হাজারীবাগের গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ বিছিন্ন করা হয়েছে। আবার সাভারেও সংযোগ দেয়া হয়নি। মাঝ থেকে কাজটা বন্ধ হয়ে রয়েছে। এমন সময় আমাদের সংযোগগুলো কাটা হয়েছে যখন কিনা মেশিনের মধ্যে পানি, কেমিক্যাল ও চামড়া দেয়া রয়েছে। সেগুলো ওই অবস্থাতেই রয়েছে। আর বের করা সম্ভব হয়নি। এখন কবে আমরা সাভারে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ পাব, এরও কোনো ঠিক নেই।’
তিনি বলেন, ‘মনে হয়, সবকিছু মিলে আমাদের কারখানা স্থানান্তরে ছয় মাস সময় লেগে যেতে পারে। এ সময়ে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। আমাদের অর্ডারগুলো সময়মত ডেলিভারি দিতে পারব না। বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। লোকসানে পড়ব আমরা।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ইলিয়াসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু একটা জায়গা প্রস্তুত হওয়ার আগেই কেন আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ কাটা হল? এখানে কোনো তৃতীয়পক্ষ কাজ করছে না তো?’ কেউ যদি এ সুযোগে চামড়া পাচারের চেষ্টা করে, তবে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময় আদালতে বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা) মিথ্যা তথ্য প্রদানের জন্য শাস্তির দাবি জানান তিনি।
গত ৬ মার্চ সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিচ্ছিন্ন করাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ১২ মার্চ কারখানাগুলো অবিলম্বে বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর সব কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফের বিষয়ে বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি গ্রহণের কথাও জানান আদালত।
৯ এপ্রিল শুনানি শেষে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের শর্তে ১৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ কোটি টাকা জরিমানা মওকুফ করেন আদালত। এছাড়া আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার করে টাকা শ্রম মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ওই টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে দিতে হবে বলে আদালত জানান।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নারায়ণগঞ্জে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত। ‘ঢাকা ট্যানারি’ নামে ওই কারখানাটি গড়ে তুলেছিলেন আরবি সাহা নামে এক ব্যবসায়ী। দানবীর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আরবি সাহার হাত ধরে গড়ে ওঠা ঢাকা ট্যানারির অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে এর মালিকানা বদল হয়েছে কয়েক দফা।
নারায়ণগঞ্জে ঢাকা ট্যানারির কার্যক্রম চলে প্রায় তিন বছর। এরপর নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করে ১৯৫০ সালে ঢাকার হাজারীবাগের বর্তমান অঞ্চলে আনা হয়।
ঢাকা ট্যানারিন পাশাপাশি সেই সময় হাজারীবাগে কার্যক্রম শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা আরও ২১টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান। এসব ট্যানারির সবকটিই ছিল তৎকালীন পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া ট্যানারি ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে তা বেড়ে ২০০টি ছাড়িয়ে যায়।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণ করা ২১টি ট্যানারি বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া হয়।
এসআই/এসআর/এমএআর/আরআইপি