ঘুমের মধ্যেও যে মানুষ হাঁপায় এটা জানতো না শাপলা। দিনের পরে দিন শাপলা একজন ক্লান্ত মানুষের সাথে ঘুমাতে যায়। যার শরীরজুড়ে থাকে সারাদিনের ক্লান্তি। শাপলার স্বামী লতিফ ভ্যান চালায়। ভ্যানে করে মানুষ নিয়ে যায় ইটেরপুল থেকে পাথুরিয়াপাড়- মোট নয় কিলোমিটার। কিছুটা পথ পিচঢালাই করা, কিছুটা পথ আস্ত ইটের আর বাকিটা মাটির। প্রতিদিন সে কম হলেও পাঁচজন মানুষ নিয়ে দশ-বারো বার আসা-যাওয়া করে এই পথে। প্রথম দিকের রাস্তাটুকু শান্তিমতো যায় কারণ ওইটুকু পৌর এলাকার মধ্যে তারপর শুরু হয় ইটের রাস্তার ধকল। লতিফের শরীরের প্রতিটি কোষে নিরবচ্ছিন্ন অনুভূতি পৌঁছায়। সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন ওই রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে তখন লতিফ হারিকেনের আলোয় দ্রুতগতিতে প্যাডল দিয়ে বাড়ি ফেরে।
Advertisement
লতিফ মাঝে মাঝে ভাবে আজকে কয়েকটা প্যাডল কম মেরে রাতে বউয়ের জন্য রেখে দেই। কিন্তু লতিফ নিরুপায়; সকালে ঘুম থেকে উঠলেই কিস্তির টাকা। লতিফ ঠিক সময় করে বাচ্চা আর ক্ষুদ্র লোন এই দুইটা জিনিস নিতে কখনো ভুল করে না। আর কিস্তির পেছনে ছুটতে ছুটতে তার জীবন তেজপাতা হয়ে যায়। অবশ্য শাপলা অনেক খুশি। তার মতে এইবারের লোনের টাকার যথাযথ ব্যবহার হয়েছে। বাড়িতে সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না আর তাই লতিফ এইবার লোনের টাকা দিয়ে একটা সিডি সেট আর টিভি কিনে নিয়ে আসে। লতিফের বাড়িতে প্রতিদিন দুইটা সিনেমা শো হয়। একটা বিকেল ৪টা থেকে আরেকটা রাত সাড়ে ৮টা থেকে। এই দুই শোতে আশেপাশের বাড়ির মানুষও এসে সিনেমা দেখে। টিভি কেনার শুরুর দিকে মধ্যরাতে শাপলা আর লতিফ একটা লেট নাইট শো দেখতো। ওইখানে অন্য দর্শকের জায়গা থাকতো না। কিন্তু আস্তে আস্তে ওই শোটাও বন্ধ হয়ে গেছে কোন একটা অজানা কারণে।
শাপলা এই অল্প কয়েকদিনেই দুই বাচ্চার মা। তার জীবনের শখ-আহ্লাদ নাই বললেই চলে। প্রতিদিন তার পাশে একজন মানুষ ঘুমের মধ্যেও হাঁপাতে থাকে। শাপলার খুব ইচ্ছে করে ওই মানুষটাকে ঠেসে ধরে একটা চুমো দিতে; যেমনটা ওইদিন টিভিতে শাকিব খান অপু বিশ্বাসকে দিয়েছিল। কিন্তু সাহস পায় না।
ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই লতিফ ভ্যান নিয়ে আবার বের হয়ে যায়। সে আবার সকালে বাড়িতে নাস্তা করে না। গরম গরম পরাটা আর ডিম ভাজা হলো তার সকালের নাস্তা। একটু স্পেশাল খাবার ছাড়া লতিফের চলে না।
Advertisement
বাড়িতে একবেলা রান্না হয়। সেটা দুপুরে। ওই খাবারই দুপুর-রাতে এবং পরের দিন সকালে সবাই খায়। প্রতিবেলা রান্নাঘরে গিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় শাপলার হাতে নেই। লতিফও কিছু বলে না। কারণ লতিফ বাড়িতে শুধু রাতের খাবার খায়। দুপুরে আর সকালে তার স্পেশাল খাবার। মাঝেমাঝে শাপলা লতিফের কাছে স্পেশাল খাবারের আবদার করে। সেই আবদার পূরণও করে লতিফ। তবে সেই পূরণের মাত্রাও আজকাল কমে গেছে। শাপলার শুধু মনে হয়, সে বোধ হয় পুরনো হয়ে গেছে। তার বাড়ির তিন বাড়ি পরেই ডলির বাড়ি। সে বাড়িতেই একটা বিউটি পার্লার দিয়েছে। শাপলার এখন আর স্পেশাল খাবারের উপরে তেমন লোভ নেই। সে লতিফের কাছে টাকার আবদার করে। গতমাসেও একবার টাকা নিয়ে শাপলা তার ভ্রু-প্ল্যাক, ফেসওয়াশ করিয়েছে ডলির পার্লার থেকে। পার্লার থেকে আসার দুই-তিনদিন অবধি শাপলাকে একটু বেশি ফর্সা দেখায়। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই আবার আগের জায়গায় চলে যায় শাপলা। অবশ্য লতিফের কোন পরিবর্তন হয় না। লতিফের কাছে কখনো শাপলাকে আলাদা লাগে না।
শাপলার খুব ইচ্ছে- একদিন লতিফ এসে ভ্যানের প্যাডল রেখে শাপলার চুলে মুঠি ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখবে। কিন্তু সেইদিন শাপলার আর আসে না। বয়স যত বাড়ছে লতিফের উপরে চাপ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে লোকজনও বেড়ে যাচ্ছে। অতটা প্রাইভেসিও নেই তাদের। শাপলা আর লতিফের শারীরিক আনন্দ হলো মধ্যরাতে পুকুর থেকে মাছ চুরি করার মতো। শাপলার এই চুরিচুরি আদর আর ভালো লাগে না। তাও আবার মাসে দুই-তিনবারের বেশি তো হয়ই না। সারারাত লতিফ তার পাশে শুয়ে হাঁপাতে থাকে আর বিড়বিড় করে কথা বলে। সেই কথার কোন কুলকিনারা খুঁজে পায় না শাপলা। তবে বুঝতে পারে, লতিফ সারাদিন অনেক রসিকতার উপরেই থাকে।
শাপলার বিনোদন বলতে শুধু সিডি। শাপলা যখন লতিফের বিনোদনের কথা ভাবে তখন দেখে, ওই লোকের জীবনে তো সেইরকম কোন বিনোদন নাই। সারাটা দিন ভ্যানের প্যাডল মারতে মারতে তার হাত-পায়ের সমস্ত শক্তি চুষে নিয়ে যায়। বেচারা নিস্তেজ হয়ে পরে থাকে বিছানায়। রাতে প্রচণ্ড গরমে শাপলা ঘুমোতে পারে না। কিন্তু লতিফ কোন বিপত্তিহীনভাবে ঘুমিয়ে যায়। তার কাছে গরম কোন কিছুই না।
লতিফের আবার লোন নেওয়ার সময় এসেছে। এইবার শাপলা বেঁকে বসেছে। সে এইবার আর সই দিবে না। আর লোন তুলতে দিবে না। কারণ লোনের কিস্তি দিতে গিয়েই লতিফের এই অবস্থা। কিস্তির চাপ না থাকলে দরকার হলে একদিন না খেয়ে থাকবে তাও প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে বের হতে হবে না। শাপলার সই ছাড়াও লতিফ লোন তুলতে পারবে না। বিশাল মুশকিলে পরে গেছে লতিফ। লোন তার তুলতেই হবে। কিন্তু কোন ভালো যুক্তি দেখাতে পারছে না- এইবারের লোন দিয়ে সে আসলে কি করবে? বুদ্ধি খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ লতিফের মাথায় একটি বুদ্ধি আসে, সবাই ইজিবাইক কিনছে। এখন আর ভ্যানের যুগ নাই। কেউ ভ্যানে অনেকক্ষণ বসে যাওয়া-আসা করে সময় নষ্ট করবে না। কিন্তু অত টাকাও তো নাই যে, একটা ইজিবাইক কিনে ফেলবে লতিফ। আর অত টাকা লোনও দিবে না লতিফকে। কিন্তু তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসছে, তার ভ্যানেই যদি মটর লাগানো যায় তাহলেই তো ইজিবাইকের মতো দ্রুত যাওয়া যাবে। আর তার কোন কষ্টও হবে না ভ্যান চালাতে। শুধু ব্রেক ধরে রাখলেই হবে। সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে লতিফ শাপলাকে বোঝালো, এই কারণে আমার লোন লাগবে। শাপলার মন গলে গেল। কারণ লতিফের কষ্ট কমে যাবে আর রাতে তার পাশে শুয়ে শুয়ে হাঁপাবে না লতিফ।
Advertisement
লোন নিয়ে লতিফ একটা মটর লাগালো তার ভ্যানে। তার ভ্যান এখন উড়ে উড়ে চলে। আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে তার ট্রিপ। বেশিবার সে আপডাউন করতে পারে। বাড়িতে একটু তাড়াতাড়িও ফিরতে পারে আগের তুলনায়। তেমন কষ্ট নাই তার কাজে। প্যাডল দেওয়ার কোন পরিশ্রম নাই।
রাতে ফিরে শাপলার ভ্যানে চরে লতিফ প্যাডল মারে। আর বলে, ‘কি লাভ হইলো? রাস্তায় প্যাডল না মারা লাগলে কি হইছে? সেই বাড়িতে আইসা তো প্যাডল মারতেই হয়।’ এই কথা শুনে শাপলা বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরে লতিফের। হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে উঠে লতিফ। আশেপাশের মানুষ জেগে উঠে বলে, ‘কি হইছে আমাগো লতিফের…।’ শাপলা হাসি চেপে ধরে উত্তর দেয়, ‘তারে বোবায় ধরছে। কিছু হয় নাই। আপনেরা ঘুমান।’ লতিফ আবার শাপলার চুলের মুঠি ধরে টেনে মাটিতে হোগলার উপরে ফেলে প্যাডল মারতে থাকে। শাপলা বলে, ‘তোমার এই রুস্তমগিরি এতোদিন কোথায় ছিলো?’ লতিফ বলে, ‘তোমারে বলছিলাম না, এইবার খালি লোনটা নিতে দাও তারপরে দেখামু তোমারে খেইল।’
আজকাল মধ্যরাতের সিনেমা শোটাও মাঝেমাঝে চালু হয়। সেই শোতে সিনেমার পাশাপাশি লতিফের স্পেশাল খাবারও আসে। দু’জনে সিনেমা দেখে আর খায়। খাবারের গন্ধ ম ম করতে থাকে সারা ঘরে। কিন্তু সকালে কেউ-ই সেই খাবারের কুলকিনারা খুঁজে পায় না। লতিফ সকালে তার বাচ্চাদের আর তার মাকে গল্প বলে, ‘তাদের বাড়ির উপরে দিয়ে প্রতিরাতে একদল জিন-পরি যায় বিভিন্ন খাবার-দাবার আর ফুল নিয়া।’ সবাই সে কথা বিশ্বাসও করে। খালি মুচকি হাসি দেয় শাপলা।
কিছুদিন ধরে শাপলার মনে হয়, তাদের কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে। কোন বাচ্চা-কাচ্চাও এখনো হয়নি। শাপলা অনেক আগ্রহ দেখাচ্ছে লতিফের কাছে, ‘চলো একটা বাচ্চা নেই’। কিন্তু লতিফ বলে, ‘না, এখনো তো তুমিই আমার কাছে বাচ্চা। আগে এই বাচ্চাটা ভালো কইরা সামলাই। তারপরে আমাগো বাচ্চা নিবোনে।’ এ কথা শুনে শাপলা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ এই কল্পনায় সে থাকতে পারে না। কারণ চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়ে যায় তাদের বাচ্চার। তখন আবার ফিরে আসে কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তব জীবনে।
সকাল বেলা লতিফ ভ্যান নিয়ে ছুটছে। ফুরফুরে একটা মন। ডিম, পরাটা ও ভাজি খেয়ে লতিফ তার ভ্যানের মটর চালু করে ইটেরপুলের দিকে রওনা দিয়েছে। ভ্যান ছুটেই যাচ্ছে পেছনে মাটির রাস্তা, ইটের রাস্তা পেরিয়ে পিচঢালা রাস্তায়। ভ্যানের সাধারণ গতির চাইতে মটর লাগানো ভ্যানের গতি তিনগুণ। লতিফ এই গতি সামলানোর দক্ষতা ওইভাবে এখনো অর্জন করতে পারেনি। তার উপরে ভ্যানের কাঠামোর সাথে মটরের কর্মক্ষমতা অতিরিক্ত।
লতিফ তার ভ্যান আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। একটা চটপটে দুরন্ত ট্রাক লতিফের ভ্যানকে চাপা দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো। ব্রেক চেপে অথবা প্যাডল বন্ধ করে অথবা অন্য কোন উপায় লতিফের কাছে ছিলো না। হয়তো ট্রাকের চালকের কাছেও কোন উপায় ছিলো না। ট্রাকের চালক হয়তো ভ্যানটিকে মটরহীন গতির ভ্যান ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সেইসব ভাবনা চিন্তা হয়তো তখন কেউ করেনি।
সবাই লতিফকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। ট্রাকের চালক কোথাও একটা গিয়ে তিন-চারদিনের জন্য লুকিয়ে আছে। এই ঘটনায় লতিফ বিশ হাজার টাকা জরিমানা পেয়েছে। তা হয়তো তার ভ্যান ঠিক করতেই খরচ হয়ে যাবে। লতিফ ভালো করে কথা বলতে পারে না। শাপলা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে ডাক্তার বাঁধা দেয়। ধীরে ধীরে হাসপাতালের মানুষ কমতে থাকে। হাসপাতালের ওই রুমে চারটা সিটে রোগীসহ মোট এগারো জন মানুষ। সবার দিকে শাপলা তাকিয়ে আছে।
রাত বেড়েই চলছে। তার পাশে শুয়ে কেউ আর হাঁপাচ্ছে না। শাপলার খুব ইচ্ছে করছে লতিফের ফতুয়ার বোতাম ছিঁড়ে বুকের মধ্যে কামড় দিতে। শাপলা না ঘুমিয়ে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। কারণ লতিফের হাঁপানোর শব্দ না শুনলে শাপলার আবার ঘুম আসে না।
এসইউ/এমএস