মতামত

নদী যেন বহতাই থাকে

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা বরাবরই অম্লমধুর। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ও সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে ভারত আমাদের কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এই কৃতজ্ঞতা চিরদিনের। কিন্তু কৃতজ্ঞতা মানেই ভারতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নয়। কৃতজ্ঞতা মানে বন্ধুত্ব, দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব। কিন্তু ৭৫এর পর বাংলাদেশের রাজনীতির নানা সমীকরণ, ভারতের নানা আচরণে দুই দেশের সম্পর্কে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রবল সঙ্কট দেখা দেয়। ভারত বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের রাজনীতির বড় এক ট্রাম্প কার্ড। আটকে থাকে অনেক অমীমাংসিত ইস্যু। সবাই রাজনীতি করেছে, কিন্তু সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সত্যিকার অর্থে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়। ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। অনেকের কাছে সমস্যা জিইয়ে থাকলেই রাজনীতি করতে সুবিধা।

Advertisement

বাংলাদেশের শান্তিবাহিনী যেমন ভারতের ভূমি ব্যবহার করে পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে রেখেছিল। আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের ৭ রাজ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে শান্তিবাহিনীর সাথে শান্তি চুক্তি করে পাহাড়ে শাস্তি ফিরিয়ে আনে। গঙ্গার পানি চুক্তি করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ইস্যুর যবনিকাপাত ঘটায়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আবার ফিরে আসে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র আসে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসে। ততদিনে ভারত স্বস্তির মজাটা পেয়ে গেছে। তারা তুলনা করতে পেরেছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে। ফলে ভারত বুঝে গেছে, আওয়ামী লীগই তাদের পরীক্ষিত বন্ধু এবং আওয়ামী লীগেই তাদের স্বস্তি বেশি।

কংগ্রেসের পর বিজেপি ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে আওয়ামী বিরোধী মহলে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। আগেই বলেছি, ভারত স্বস্তির মজাটা পেয়ে গিয়েছিল। তাই আওয়ামী বিরোধীদের উল্লাস মিইয়ে যেতে সময় লাগেনি। বরং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। মিটে যায় দীর্ঘদিনের সীমান্ত সমস্যা, সমূদ্র সীমা সমস্যাও। ভারতও ট্রানজিটের মাধ্যমে ৭ রাজ্যে সহজ যাতায়াত সুবিধা পায়। তবে সবকিছু আটকে যায় তিস্তা পানি বণ্টন ইস্যুতে এসে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংএর বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা, যিনি এতদিন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, তার বাগড়ায় আটকে যায় চুক্তি। তারপর থেকে মমতা বাংলাদেশে ভিলেন, মমতাহীনা এক নারীর নাম।

কিন্তু ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে এসে উষ্ণ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা পান। তখন একাধিক অনুষ্ঠানে মমতা বাংলাদেশের মানুষকে তার ওপর ভরসা রাখতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদেরও প্রবলেম আছে, আমাদেরও প্রবলেম আছে। তবে এটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এটি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করবেন না।’ আমরা মমতা ব্যানার্জির আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমরা অবুঝ নই। আমরা বুঝেছিলাম নির্বাচনকে সামনে রেখে মমতার পক্ষে তিস্তা চুক্তিতে সায় দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু গতবছর যখন মমতা আবার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এলেন, তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, এবার নিশ্চয়ই তিস্তার পানি পাবো। কিন্তু মমতা যেভাবে নানা অজুহাত তুলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তার ওপর ভরসা করে বসে থাকার দিন ফুরালো।

Advertisement

আসলে তিস্তা ভারতের রাজনীতিরও একটা বড় ইস্যু। কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে মমতার সম্মতি ছাড়াই বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের সম্মতির বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাইরের দেশের সাথে চুক্তি করার ক্ষেত্রে নেই। আসলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের সাথে মমতার একটা চোর পুলিশ খেলা চলছে। দায়িত্বটা কেউ নিতে চাইছে না। বালিশ খেলার মত সবাই বালিশটা ঠেলে দিতে চাইছে। যেন বালিশ হাতে থাকলেই আউট। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনের নানা হিসাব-নিকাশ। ভারত দখলের প্রক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টি এখন পশ্চিমবঙ্গের দিকে। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে কেউই আসলে তিস্তার দায় নিতে চাচ্ছেন না। মোদি চান মমতার ঘাড়ে দায় চাপাতে, আবার মমতা চান মোদির দিকে বল ঠেলে দিতে। নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনে তিস্তা একটি বড় ইস্যু হবে। শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিঙে মোদি স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর এবং শেখ হাসিনার সরকারই তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে পারবে। তার মানে আবার আমরা আশ্বাসের চক্করে আটকে গেলাম।

তিস্তা নিয়ে মমতার স্পর্শকাতরতা বুঝতেও আমাদের অসুবিধা হয় না। তার দাবি, তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি নেই। এটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গে আসার আগেই বিভিন্নস্থানে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করা হয়। তাই তিস্তার পানির বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে। শুধু মমতার ওপর দায় না চাপিয়ে তিস্তায় পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিস্তা নিয়ে ভারতের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ তারা করুক। তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা আমাদের ন্যায্য পানি চাই এবং সেটা অবিলম্বে। ৪৬ বছর ধরে আমাদের ঠকানো হয়েছে। আমরা আর ঠকতে চাই না। শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ ভারতকে সব দিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে ভারত তিস্তা দিক। আমি এই বিনিময়েও বিশ্বাসী নই। ট্রানজিটটা ভারতের দরকার ছিল, বাংলাদেশ দিয়েছে। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার, আমরা তা চাই। ব্যস। ভারতকে ট্রানজিট না দিলে কি আমাদের তিস্তার দাবির ন্যায্যতা কমে যায়। ট্রানজিট দিয়ে আমরা সৎ প্রতিবেশির দায়িত্ব পালন করেছি। এখন ভারতের দায়িত্ব। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশি। আর আপনি বন্ধু বদলাতে পারবেন, প্রতিবেশি বদলাতে পারবেন না।

এটাও ঠিক ভারতের সাথে ঝগড়াঝাটি করে দাবি আদায় করা যাবে না। আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমেই আদায় করতে হবে। যৌথ ব্রিফিঙে হাসিনা-মোদি দুজনেই শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয়, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রগতির স্বপ্নের কথা বলেছেন, স্থিতিশীলতা-শান্তির কথা বলেছেন। কিন্তু নিকট প্রতিবেশিকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত রেখে ন্যায্য রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নরেন্দ্র মোদি যতই বড় বড় কথা বলুন, তা শুধু কথায় আটকে থাকলে চলবে না।

Advertisement

ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, ২৫ বছরের গোলামি চুক্তির গল্প। শুনে আসছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে। কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো অমীমাংসিত বিষয় মিটিয়েছে। কিন্তু বিএনপি ভারত বিরোধী রাজনীতি করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দফায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও কোনো সমস্যাই মিটা্য়নি। আসলে মিটে গেলেই রাজনীতি ফুরিয়ে যায়। বিএনপি তার আগের কট্টর ভারত বিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। দুদিন আগে মির্জা ফখরুল এক ব্রিফিঙে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তারপরও ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে পুরোনো রাজনীতি শুরু করেছে। এই চুক্তি বা সমঝোতকা স্মারক হলে নাকি দেশের সার্বভৌমত্ব চলে যাবে।

আমি অত শঙ্কিত নই। একাত্তরে কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি ছাড়াই ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আসলে ভারতের মনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থা্কলে, প্রতিরক্ষা চুক্তি থাকা না থাকায় কিচ্ছু যায় আসে না। আসল কথা হলো বন্ধুত্ব। যারা কথায় কথায় বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেয়ার শঙ্কার কথা বলেন, সার্বভৌমত্ব চলে যাচ্ছে বলে ভয় দেখান; তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ভারত যদি চায়, তাহলে আপনি কিভাবে ঠেকাতে পারবেন?

আসল কথা হলো সততা নিয়ে, সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হবে; আলোচনা-সমঝোতা করতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহায়তা করেছে বলে, আগে ভারতের মধ্যে এক ধরনের দাদাগিরি মনোভাব ছিল। কিন্তু এক দশকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশে এখন ন্যায্যতার প্রশ্নে আমেরিকাকে পাত্তা দেয় না, বিশ্বব্যাংককে পাত্তা দেয় না; ভারতকে পাত্তা দেয়ারও টাইম নাই। এই সময়ে বাংলাদেশ যেমন এগিয়েছে, ভারতের মনোভাবও অনেকটাই বদলেছে। ভারত অবশ্যই আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশি।

ভারত অবশ্যই আমাদের বড় ভাই। কিন্তু এলডার ব্রাদার হলে সম্মান করবো, বিগ ব্রাদার হলে পুছবোও না। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা একতরফা নয়। বাংলাদেশ ছোট হতে পারে, কিন্তু একটি স্বাধীন-সার্বভোম রাষ্ট্র। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আসুন, আমরা আরো উষ্ণতা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেবো। কিন্তু দাদাগিরি করতে আসলে আমরা শেষ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করবো। আগেই বলেছি, সম্পর্কটা একতরফা নয়। ভারতের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই বাংলাদেশকে দরকার।

৭ বছর পর শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে কেউ কেউ হতাশা ব্যক্ত করছেন। এটা ঠিক সবার নজর ছিল তিস্তার দিকে। তিস্তা চুক্তি হলেই শেখ হাসিনার সফরকে সর্বাঙ্গ সফল বলা যেতো। তিন্তু তিস্তা চুক্তি যে আলোচ্য সূচিতে নেই, এটা তো আগেই জানা। তাই তিস্তা নিয়ে কোনো প্রত্যাশাও ছিল না। প্রত্যাশা না থাকলে হতাশার প্রশ্নটিও অবান্তর। প্রটোকল ভেঙে শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি চমক দেখিয়েছেন। আশা ছিল, মমতাকে ডেকে এনে যে আবহ তৈরি করা হয়েছিল, তাতে সূচিতে না থাকলেও মোদির কাছে তিস্তা নিয়েও তেমন কোনো চমক আছে কিনা। সে অর্থে হতাশ হতেই হয়েছে। ভারত শেখ হাসিনাকে অনেক সম্মান দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার মত নেত্রীর এই সম্মান পাওনা। শুধু সম্মান দিয়ে বুঝ দেয়ার দিন শেষ। আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। সীমান্তে ভারতের নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হবে।

শেখ হাসিনা যেদিন ভারত গেলেন, সেদিন ভারতের পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা ছাপা হয়েছে। সে লেখায় তিনি বলেছেন, বন্ধুত্ব একটি বহতা নদীর মত। অবশ্যই বন্ধুত্ব বহতা নদীর মত। কিন্তু খালি কথায় আর আশ্বাসে বন্ধুত্বের নদীতে স্রোত থাকবে না। টেকসই বন্ধুত্বের জন্য, বহমান নদীর জন্য তিস্তায় পানি চাই, অবিলম্বে।

৮ এপ্রিল, ২০১৭probhash2000@gmail.com

এইচআর/এমএস