বিশেষ প্রতিবেদন

এ অ্যাওয়ার্ড আমার নয়, সকল মেয়েদের : শারমিন

সকাল থেকে কয়েকবার ফোন। অবশেষে পাওয়া গেল দাদীর ফোনে। কণ্ঠে উচ্ছ্বলতার আঁচ। উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরে দেখা করার সময়ও তা চোখে পড়লো। সব সময় হাসি লেগে থাকা মিষ্টি একটি মুখ। হালকা পাতলা গড়নের এ মেয়েটিই সাহসিকতার সেরা পুরষ্কার এনে দেশকে গর্বিত করেছে। তবে এমন ভাবনায় ডুবে যাওয়ার আগেই সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় সারলো ঝালকাঠির রাজাপুরের ছোট্ট কিশোরী শারমিন আক্তার (১৭)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডব্লিউওসি) অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ এ ভূষিত হয়েছে শারমিন।

Advertisement

মাত্র ১৫ বছর বয়সেই প্রবাসী বাবার একমাত্র মেয়েকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন মা গোলনূর। রাজি না হওয়ায় তার উপর চলে নির্যাতন। সেখান থেকে পালিয়েও রেহাই না পেয়ে আইনের সাহায্য নেয় শারমিন। কিশোরী বয়সে নিজের বিয়ে বন্ধ করতে মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার সেই সাহস শারমিনকে করে তুলেছে ‘সাহসী নারী’। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নারীদের উদাহরণ হয়ে ওঠেছে সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেয়া এ মেয়েটি।

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শারমিনকে সেক্রেটারি অফ স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডব্লিউওসি) অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ সম্মানে ভূষিত করেছে। গত ২৯ মার্চ (বুধবার) ওয়াশিংটনে এক আড়ম্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের হাত থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করে বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) দেশে ফিরেছে শারমিন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। একান্ত আলাপে শারমিন জানায় সেদিনের ‘সেই’ রুখে দাঁড়ানোর গল্প। মুখে শোনা যায় ভবিষ্যতের স্বপ্নও।

Advertisement

কেন সেদিন মায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিল ১৫ বছরের এক কিশোরী -জানতে চাইলে হাসিমুখ কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। তবু বলে চলে শারমিন। জানায়, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সাহস করে মায়ের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলাম সেদিন। অন্য কোনো ভাবনা থেকে নয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শারমিন জানায়, ‘নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মা হঠাৎ করেই ৩৫ বছর বয়স্ক এক লোকের সঙ্গে আমার বিয়ের দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজি না হলে মিথ্যে বলে খুলনায় নিয়ে স্বপন খলিফা নামের ওই লোকটির সঙ্গে একটি ঘরে আটকে রেখে ভীষণ মারধর করে।’

‘দু’দিন মারধরের পরে বিয়েতে রাজি হওয়ার কথা বলে খুলনা থেকে পালাই। বাস থেকে ধরে ফেলায় আবারও রাজাপুরের নিজেদের ভাড়া বাসায় বিয়ের আয়োজন করতে থাকে। শেষবারের মত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে বান্ধবীদের পরামর্শে প্রথমে সাংবাদিক ও পরে পুলিশের কাছে যাই।’

‘পুলিশ প্রথমে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিতে বললেও পরে সাংবাদিকদের চাপে মামলা নেয়। কয়েকমাস পর সেই লোকটা (স্বপন খলিফা) ধরা পড়ে। মা’ও আত্মসমর্পণ করে। তারা কয়েকমাস করে জেল খেটেছে। তবে মায়ের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। বাবা বিদেশ থেকে ঘটনা শুনেই আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন’- বলে শারমিন।

Advertisement

এসব কথার ইতি টানতেই চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের গল্প শোনার পালা। প্রসঙ্গটি আসতেই আবারও চোখে-মুখে উচ্ছ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে শারমিনের। জানায়, ‘প্রথমে খবরটির তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার পরে বুঝেছি- এ পুরস্কার কতটা সম্মানের। সত্যি আমি ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি। এ অ্যাওয়ার্ড আমার জন্য নয়, দেশের সকল মেয়েদের জন্য।’

‘নিজের জন্যই সেদিন বাল্যবিয়েটা ঠেকিয়েছিলাম। কিন্তু এই পুরস্কার আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি দেশের সব মেয়ের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে চাই।’- বলে শারমিন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শারমিন জানায়, ‘নিজের পড়া-লেখাটা শেষ করতে চাই। আইনজীবী হতে চাই। কারণ, আমার মনে হয় আইনজীবী হলে আরও বেশি বাল্যবিবাহ ঠেকানোর মত কাজ করতে পারব। আমি চাই দেশে আর একটি বাল্যবিবাহের ঘটনাও না ঘটুক।’

নিজ গ্রামে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেশি জানিয়ে এ ‘সাহসী কিশোরী’ জানায়, গ্রামে ১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিছুই করতে পারি না। তবে আমার ওই ঘটনার পর এখন অনেক মেয়েরাই সাহসী হয়ে ওঠেছে।

দেশের যে সকল মেয়েরা বাল্যবিয়ে ঠেকাতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে শারমিনের পরামর্শ- ‘আমি চাই আমার বিষয়টা তারা জানুক।  ভয় পেলে চলবে না। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলেই সকল বাধা পার করা যাবে। নিজেদেরকে অসহায় না ভেবে সাহস করে এগিয়ে আসতে হবে।’

যে বাল্যবিবাহ আটকে শারমিনের এ অর্জন, বাংলাদেশে ‘শর্তসাপেক্ষে’ সেই বাল্যবিয়ে দেয়ার আইন হয়েছে। এ বিষয়ে শারমিন জানায়, ‘আইন নিয়ে কিছু বলতে চাই না। মেয়েটির অমতে যদি ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়া হয়, আমি তার সাহায্যে এগিয়ে আসব।’

কিছুদিন পর এসএসসি পরীক্ষা ফল প্রকাশ হবে। শারমিনের ইচ্ছে, ঢাকার কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার। পরীক্ষায় এ প্লাস (জিপিএ-৫) পাওয়ার আশা উল্লেখ করে শারমিন জানায়, ‘এখন গ্রামে থাকা কিছুটা অনিরাপদ। কারণ, মামলা চললেও স্বপন জামিনে রয়েছে। গ্রামেই থাকে সে। যেকোনো সময় ক্ষতিও করতে পারে। তাই ঢাকায় চলে আসতে চাই।’

যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আশ্বাস পেলেও তা নাকচ করেছে দিয়েছে শারমিন। জানায়, ‘আমেরিকায় বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়েছে। তারা বার বার জানতে চেয়েছে- দেশে কোনোভাবে অনিরাপদ বোধ করি কিনা। করলে আমেরিকাতেই থাকার ব্যবস্থা করা হবে।’

তবে শারমিন তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। তার ভাষায়, ‘আমি আমার দেশেই থাকতে চাই। সেখান (বাংলাদেশ) থেকেই নিজের পড়া-লেখা শেষ করতে চাই।’

শারমিন আরও জানায়, ‘মায়ের সঙ্গে এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই, তবে আট বছরের ছোট ভাইকে খুব মনে পড়ে। তারপরেও মায়ের কাছে ফিরতে চাই না।’

‘যতদূর ইচ্ছে পড়তে পারব বলে বাবা, দাদী, ফুফুদের সমর্থন পাচ্ছি। আমি নিজেকে সেই যুদ্ধে জয়ী করতে চাই। নিজেকে মানুষ করাই এখন আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ’ -বলে শারমিন।

জেপি/আরএস