খেলাধুলা

মাশরাফি আছেন মাশরাফির মতোই

‘হ্যাঁ, আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি এবং আমরা প্রতিটা সাফল্য উপভোগ করি কিন্তু বাবা এটা শুধুমাত্রই একটা খেলা’ -বাংলাদেশ দলের সদ্য সাবেক হওয়া টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ঘরে বেশ বড় করেই লেখা ওপরের শব্দগুলো। তিনটি ক্রিকেট ব্যাটের ওপর এ লেখাগুলো এমনভাবে সাজানো যাতে তাতে আপনি সহজেই বুঝে যাবেন ক্রিকেটের সঙ্গে মাশরাফির আত্মার টানটা কোথায় আর পার্থক্যই বা কোথায়?

Advertisement

হৃদয় দিয়ে ক্রিকেট খেলেন মাশরাফি। এ কথায় যিনি ভিন্নমত প্রকাশ করবেন শুধু তার উদ্দেশ্যে বলা, সাত-সাতবার ছুড়িকাঁচির নিচে যেতে হয়েছে তাকে। শেষবার যখন অস্ত্রোপচার করালেন তখন তার শল্যচিকিৎসক ডেভিড ইয়ং বলে দিয়েছেন, এরপর তার কাছে আসতে হলে তিনি তাকে পঙ্গু হওয়া থেকে বাঁচাতে পারবেন না। অর্থাৎ একটি ইনজুরি মানেই সারা জীবনের জন্য লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা। এরপরও খেলে চলছেন মাশরাফি। শুধু কি খেলছেন, তুখোড় নেতৃত্ব দিয়ে বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।

মাশরাফি যখন দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন হারের বৃত্ত ভাঙতেই পারছিলেন না টাইগাররা। আফগানিস্তানের মতো দল চোখ রাঙিয়ে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশকে হারিয়ে গেছে, তাও আবার আমাদের ঘরের মাঠে। তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল দলটির আত্মবিশ্বাস। সেখান থেকে দলকে শুধু বের করে আনেননি, রীতিমতো আজ আমরা সেরা দলটির একটি। ঘরের মাঠ ছেড়ে এখন বাইরের মাঠে আজ দাপটের সঙ্গে জয় তুলে নিতে পারি।

সেই মাশরাফির একটা অধ্যায় শেষ হলো আগের দিন। ক্রিকেটের ছোট সংস্করণে আর দেখা যাবে না তাকে। নির্মম কিন্তু এটাই সত্য। কিন্তু বিদায়টা কি সুখকর হলো? বাংলাদেশকে যিনি দুহাত ভরে দিয়েছেন তিনি কি দেশের মাটিতে চেনা দর্শকের সামনে থেকে বিদায় নেওয়ার দাবি রাখেন না? ক্রিকেট ভক্তকুল একবাক্যে মেনে নেবেন এটা, কিন্তু মানবেন না কেবল বাংলাদেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তারাই!

Advertisement

কর্তাদের দৃষ্টিতে মাশরাফি অবসর নিয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। এতে কোচ বা বোর্ড কর্মকর্তাদের হাত নেই। তাই বলে কি তারা মাশরাফির ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করেননি? ছোট্ট একটা উদাহরণ, শ্রীলঙ্কা সিরিজের আগে বাংলাদেশ সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছিল নিউজিল্যান্ডে। আর সেখানে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন রুবেল হোসেন, তিন ম্যাচে পেয়েছেন সাত উইকেট। অবাক করা ব্যাপার সেই রুবেল লঙ্কা সিরিজের দলেই নেই।

অনেকে এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেবেন কিন্তু যারা ক্রিকেটের নুন্যতম খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন রুবেলকে মাশরাফি কতটা স্নেহ করেন। তার ওপর আবার সে নিয়মিত পারফরমার। কোচ মাশরাফিকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তোমার জন্য যোগ্য খেলোয়াড়কেও আমাকে বাদ দিতে হয়।

এতো গেল ছোট একটা যুক্তির কথা, এবার আসি আবেগের কথায়। মাশরাফি যেদিন অবসর নিয়েছেন সেদিন নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কেউ তোমার মূল্যায়ন করতে না পারলে নিজেকে আড়াল করে নেওয়াই ভালো। ভেবো না তুমি মূল্যহীন। আসলে তোমাকে মূলায়ন করার ক্ষমতা তার নেই!’

আরও একটি টাটকা ঘটনা। আজ শুক্রবার দুপুরে দেশে ফিরেছেন মাশরাফি। বিমানবন্দর থেকে সোজা মিরপুরে নিজের বাসায়। বাসার সামনে রাস্তার কাজ চলতে থাকায় নামতে হলো একটু আগেই। নামার পরই শুনতে পেলেন, বাবা! বাবা! বলে চিৎকার। উপর থেকে দুই ছেলে মেয়ে হুমাইরা ও সাহিল ডাকছে তাকে। দৌড়ে নামল সন্তানরা। তাদের নিয়ে বাসায় উঠলেন মাশরাফি। দরজায় স্ত্রীর সঙ্গে চোখাচোখি। পাশ কেটে গিয়ে ফ্লোরে বিছানো মাদুরে গা এলিয়ে দিলেন মাশরাফি।

Advertisement

অনেকেই বলতে পারেন ভ্রমণক্লান্তি কিংবা আগের রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে। কিন্তু প্রায় মিনিট দশেক পর আপন মনেই বললেন, ‘ক্রিকেট খেলি আবেগ দিয়ে, টাকার জন্য নয়। টাকা কামাতে চাইলে আমার অনেক পথ আছে টাকা কামানোর। আমার সেই আবাগের একটা জায়গা ছাড়তে হলো।’ এরপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস!

আবেগ উচ্ছ্বাস সব যেন হারিয়ে ফেলেছেন অধিনায়ক। চিরচেনা হাসিখুশি মানুষটা আজ অনুপস্থিত। তারপরও বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যারা আছেন তাদের খোঁজ খবর নিলেন। বুঝিয়ে দিলেন এমন বিদায়ে ভেঙেছেন, মচকাননি। মাশরাফি আছেন মাশরাফির মতোই। পাঞ্জাবি গায়ে তুলে বললেন, ‘যাই নামাজটা পরে আসি।’ এরপর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন, ‘দেখা হবে ঢাকা লিগে।’

আরটি/এনইউ/এমএস