জন্মিলে মরিতে হয়- এটা পৃথিবীর অমোঘ বিধান। কেউ খণ্ডাতে পারবে না। তেমনি, মানুষের জীবনেও সব কিছুতেই কোনো কিছুর শুরু মানেই তার শেষ অবধারিত। একজন ক্রিকেটার তার ক্যারিয়ার শুরুর পরই যে নির্ধারিত হয়ে যায়- একদিন তাকে অবসর নিতেই হবে। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখতে হবে। নিয়তির এই অমোঘ বিধান পাল্টানোর কারও কোনো ক্ষমতা নেই। প্রকৃতির নিয়ম মেনে অনেক রথি-মহারথিকেও একদিন সব কিছুকে বিদায় বলে দিতে হয়েছে। মাশরাফি বিন মর্তুজাকেও বিদায় বলে দিতে হলো। তিনি বিদায় জানিয়ে দিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে।
Advertisement
বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরটাও আর তার নিজের ইচ্ছেমত চলছিল না। হাঁটুতে সাত-সাতটি বড় অস্ত্রোপচার। ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি। দু’তিনটি হলেই একজন ক্রীড়াবীদ ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে দিতে বাধ্য হন। সেখানে মাশরাফি সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়েও দিব্যি খেলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ দলকে নিজের কাঁধে করে বয়ে এনেছেন এই পর্যন্ত। বয়ে বেড়িয়েছেন ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার বিশাল বোঝাও। যে ক্যারিয়ারটা(টি-টোয়েন্টি) শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে, ১০ থেকে ১১ বছর পর তাকে বিদায় বলে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। বিদায় বলে দিলেন মাশরাফিও। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে যতি চিহ্ন এঁকে দিলেন দ্য কাপ্টেন, মাশরাফি বিন মর্তুজা।
মাশরাফি একটি আবেগের নাম। মাশরাফি একটি অনুপ্রেরণার নাম। সারা দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার স্থল। মাশরাফি থাকলেই মানুষ মনে করে, বাংলাদেশ বুঝি তার অনুপ্রেরণাতেই জিতে যাবে। কিংবা মাশরাফি উপস্থিত থাকলেই যেন জয়ের কাজটি অর্ধেক সমাধা হয়ে যায়। বাকি কাজটা তুলে আনতে হয় পারফরম্যান্স দিয়ে। বিপিএলে ২০১৫ আসরে তো সেটাই করেছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ইনজুরড, ম্যাচের জন্য পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও মাশরাফিকে তারা অনুরোধ করেছিল, শুধু অধিনায়ক হিসেবে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে, তাতেই তারা জিতে যাবে। মাশরাফিকে তখন স্পিন বোলিং করতেও দেখা গিয়েছিল।
এমন একজন অধিনায়ক যখন ‘নতুনদের জায়গা দিতে হবে’ বলে হুট করেই নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই এটা মেনে নিতে পারে না এ দেশের মানুষ। তারা ঠিকই বুঝে নেন, মাশরাফির আচমকা এই অবসর ঘোষণার পেছনে কোনো ‘কালো হাত’ রয়েছে। কারও চাপে পড়ে তিনি বিদায় বলতে বাধ্য হয়েছেন। খবরও চাউর হয়েছে, বিসিবির চাপেই তিনি অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। কোচ হাথুরু চান না বলেই। কোচ চান টি-টোয়েন্টিতে নতুন রক্তের সঞ্চার। তাই বলে চিরায়ত এক যোদ্ধাতে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হলো না বিসিবি!
Advertisement
গত ১০টি বছর একের পর এক অপারেশন করা আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটুর ওপর ভর নিয়েছিলেন পুরো ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার। একের পর এক জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন মানুষকে। খেলোয়াড় হিসেবে সব সময়ই ছিলেন সামনের সারিতে। নেতা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। ২০১৪ সালে অধিনায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর আমূল বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশ দলকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দিয়েছেন মাশরাফি। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে তাই, দেশের কাছে একটি জয় আশা তিনি করতেই পারেন। অবশেষে দেশের প্রতিনিধি হয়ে মাশরাফির সতীর্থরাই তাকে জয়টা উপহার সিহেবে তুলে দিলেন তার হাতে। শ্রীলঙ্কাকে তাদেরই মাটিতে ৪৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে।
রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম মাশরাফির বিদায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলো। এই প্রেমাদাসায় খেলে খেলে বেড়ে ওঠা একজন ক্রিকেটার, যিনি কি না একটি দেশের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এক সময়। অর্জুনা রানাতুঙ্গা। যিনি লঙ্কানদের তুলে দিয়েছিল বিশ্ব দরবারের সবচেয়ে উুঁচু মঞ্চে। জিতিয়েছিল বিশ্বকাপ। মাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলাদেশে অর্জুনা রানাতুঙ্গার মত। হয়ে উঠেছিলেন দেশের প্রতীক। তিনি হয়তো বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি; কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এমন এক স্থানে রেখে যাচ্ছেন, যেটা দেখে রানাতুঙ্গার মত ব্যক্তি বলতে বাধ্য হলেন, ‘২০২৩ বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশ।’
গত মঙ্গলবার হঠাৎ বজ্রাহতের মতই ঘোষণাটা আসলো তার কাছ থেকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই সিরিজই তার শেষ। এরপর আর সংক্ষিপ্ত সংস্করণের এই ক্রিকেট আর খেলবেন না। মঙ্গলবার শেষের আগের ম্যাচ আর আজ (বৃহস্পতিবার) খেলে ফেললেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। বিদায়ী ম্যাচে সতীর্থরা জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করে তাকে উপহার দিলো একটি অসাধারণ জয়। অধিনায়কের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! কিন্তু বিজয়টা বিষাদে পরিণত হয়েছে ভক্তদের জন্য। তারা যে আর মাশরাফি নামক কোনো যোদ্ধাকে টি-টোয়েন্টি মাঠে দেখতে পাবে না!
২০০৯ সালে ইনজুরির কারণে টেস্ট ছেড়েছিলেন। যদিও আনুষ্ঠানিক বিদায় এখনও বলেননি। এবার ছেড়ে দিলেন টি-টোয়েন্টি। বাকি রইলো ওয়ানডে। সময়ের পরিক্রমায় এই সংস্করণকেও ছেড়ে দেবেন একদিন মাশরাফি। হয়তো আগামী জুনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর। কিংবা বড়জোর ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। এরপরই ক্রিকেটে ‘সাবেক’ হয়ে যাবেন মাশরাফি, হয়ে যাবেন অতীত। এভাবেই সব কিছু বিদায় নেয়, বিদায় নিতে হয়। সুতরাং, বিদায় নিলেন মাশরাফিও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে।
Advertisement
আইএইচএস/