বিশেষ প্রতিবেদন

‘নারী নেতৃত্ব থাকায় বাংলাদেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে’

তালেবান আক্রান্ত যুদ্ধবিধস্ত আফগানিস্তানের নারী এমপি ফৌজিয়া কুফি। সংসদ সদস্যদের বৃহত্তর ফোরাম ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলনে ঢাকায় এসেছিলেন। ফোরামের ‘কমিটি অন দ্য হিউম্যান রাইটস অব পার্লামেন্টারিয়ান’র প্রেসিডেন্টও তিনি।

Advertisement

আফগানিস্তানের মত একটি রাষ্ট্রে কীভাবে এমপি হলেন, দেশের জনগণ তাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে এছাড়া বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সম্মেলনের শেষ দিন বুধবার (৫ এপ্রিল) সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সিরাজুজ্জামান।

জাগো নিউজ : আফগানিস্তানে সুন্নি এবং পশতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নামে উগ্রবাদী তালেবানরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। সেখানে নারীদের অনেকটা দাস হিসেবে রাখা হত। এ পরিস্থিতিতেও আপনি সংসদ সদস্য হয়েছেন?

ফৌজিয়া কুফি : তালেবান শাসনের পরে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট দিন দিন ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। তালেবান শাসন আমলে নারীদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। নারীদের জন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। আমি সেই সময় মেডিকেলের ছাত্রী ছিলাম। আমাদেরও শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এমনকি কোনো নারীর চিকিৎসার দরকার হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে দেয়া হয়নি। গর্ভবতী নারীদেরও ডাক্তারের কাছে নেয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তালেবান শাসনামলের অবসান হওয়ার পর অনেক পরিবর্তন এসেছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : সেখানে আসলে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে?

ফৌজিয়া কুফি : সংসদে বর্তমানে ২৭ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। আর নিম্নকক্ষে ২৪৯ এমপির মধ্যে ৬৯ জন নারী সদস্য রয়েছেন। এটা আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথম। এখন নারীরা শিক্ষা পাচ্ছেন। তবে নারীদের প্রতি এখনও ব্যাপক সহিষ্ণুতা হয়। কিন্তু দিন দিন এর পরিবর্তন হচ্ছে।

জাগো নিউজ : অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন। নারী নেতৃত্ব ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। এ জন্য কি আপনার উপর কখনও হামলা হয়েছে?

ফৌজিয়া কুফি : শুধু একবার নয়। আমি অনেকবার তালেবানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। তারা শুধু আমাকে হুমকিই দেয়নি, অনেকবার হত্যার চেষ্টা করেছে। আমি মনে করি তালেবানরা প্রতিনিয়তই নারী অ্যাক্টিভিস্টদের আক্রমণ করতে চায়। কারণ দেশের বিরোধী দল এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। তারা নারী নেতৃত্বের বিরোধী।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনি কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন?

ফৌজিয়া কুফি : আমার উপর তালেবানরা গ্রেনেড হামলা করেছিল। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। কিন্তু আমার বডিগার্ড আহত হয়েছিলেন। প্রত্যেক দিন কোনো না কোনোভাবে হুমকি পাই। চিঠি দিয়ে হুমকি দেয়। তবে শুধু আমি নই। এ ধরনের হুমকি প্রত্যেকটি সচেতন নারীকেই দেয়া হয়।

জাগো নিউজ : দেশের এমন সংঘাতময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মের নামে নারীদের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করে রাখার পরিবেশ থেকেও আপনি কেন রাজনীতিতে এলেন?

ফৌজিয়া কুফি : আমি ১২ বছর ধরে রাজনীতিতে আছি। রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা রাজনীতি করতেন। তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। মুজাহিদিরা তাকেও হত্যা করেছে। আমার প্রত্যেক ভাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমার বোনও একজন সংসদ সদস্য। আমি দেখেছি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে হলে, উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হলে রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতি করলে মানুষ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করা যায়। এ জন্য আমি প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও রাজনীতিতে এসেছি।

ফৌজিয়া কুফি : আপনি বলছেন আফগানিস্তানে পরিবর্তন আসছে। কীভাবে এ পরিবর্তন আসছে বলে মনে করেন?

ফৌজিয়া কুফি : প্রথমত এখন আর তালেবান শাসন নেই। আফগানিস্তানের তরুণ ও নারীদের জন্য বর্তমানে পরিবর্তন আসছে। আমি নারীদের প্রতি খুবই আস্থাবান। সেইসঙ্গে যুব সমাজের প্রতিও আমার বিশ্বাস আছে। তারাই দেশকে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকেও তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস রাখতে হবে, তাহলে আরও উন্নয়ন হবে।

জাগো নিউজ : আমরা কথায় কথায় বলি নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। এটি কি আসলেই কথার কথা, নাকি কোনো সত্যতা আছে? আপনি কী মনে করেন রাজনীতি এখন নারীদের জন্য উপযুক্ত স্থান?

ফৌজিয়া কুফি : একজন নারী হিসেবে রাজনীতি করা খুবই কঠিন কাজ।সেটা বিশ্বের যেকোনো দেশেরই নারী হোক না কেন। কারণ অনেক পুরুষই নারীর প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না। তারা শুধু নারীর হিজাব, পোষাক নিয়ে চিন্তা করেন। আর সমালোচনা করেন। এভাবেই পুরুষরা নারীদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন।

নারীদের জন্য রাজনীতি কঠিন। কারণ বিশ্বে নারী-পুরুষের সমতা নেই। পুরুষদের বিশ্বাস করতে হবে নারীরা আরও সুন্দর বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। তবেই পরিবর্তন আসবে। জাগো নিউজ : বাংলাদেশে প্রধান কয়েকটি পদে নারী নেতৃ্ত্বে রয়েছে। বিষয়টিকে আপনাদের উৎসাহী করে কি?

ফৌজিয়া কুফি : আপনাদের দেশের (বাংলাদেশ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের জন্য একটি রোল মডেল। বাংলাদেশ নারী নেতৃ্ত্বে বিশ্বাস করে। এ জন্য এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ অনেক নারী মন্ত্রী ও এমপি হতে পেরেছেন। এ জন্যই দেশটি দ্রুত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : হিউম্যান রাইটস অব পার্লামেন্টারিয়ানের প্রেসিডেন্ট আপনি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এমপিরা অনেক ক্ষমতার অধিকারী। অনেক সময় তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে থাকেন। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

ফৌজিয়া কুফি : আপনার সঙ্গে আমি একমত প্রকাশ করছি। অনেক সময় এমপিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। কিন্তু এটাও একটি বিরাট বাস্তবতা যে, রাজনীতি করায় এমপিদের প্রতিহিংসার স্বীকার হতে হয়। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। অনেককে জেলে পাঠানো হয়। হত্যাও করা হয়। আমরা এসব বিষয় নিয়েই কাজ করি।

জাগো নিউজ : এ ব্যাপারে কী ধরনের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে আপনার কাছে?

ফৌজিয়া কুফি : গত এক বছরে এমপিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে ৪৫৯টি ঘটনা কমিটির কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সম্মেলন চলাকালীন ১৪৭টি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেলে পাঠানো হয়েছে।

এমপিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে আমেরিকা মহাদেশে। ২০১৬ সালে এ মহাদেশ থেকে মোট ১৫৫জন এমপির মানবাধিকারের অভিযোগ পেয়েছে আইপিইউ। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে এশিয়া মহাদেশে ১১০জন, আফ্রিকায় ৮৯জন, ইউরোপে ৬৩জন, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৩৯জন এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তিনজন এমপির মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছে আইপিইউ।

জাগো নিউজ : আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ।

ফৌজিয়া কুফি : আপনাকেও ধন্যবাদ।

এইচএস/আরএস/এএইচ/পিআর