একটি পুরানো গল্প বলছি। আপনারা সবাই গল্পটি জানেন। আমি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসে শিক্ষক প্রশ্ন করছেন তার ছাত্রকে, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’ ছাত্র উত্তর দিচ্ছে ‘বিয়ে করা’। শিক্ষক: আমি বলতে চেয়েছি তুমি বড় হয়ে কী হবে?ছাত্র: আমি জামাই হবো।শিক্ষক: বোকা, তুমি বড় হয়ে বাবা মায়ের জন্য কী করতে চাও?ছাত্র: বিয়ে করে বউ নিয়ে আসতে চাই।শিক্ষক: ঠিক করে বলো, তুমি দেশ ও সমাজের জন্য কী করবে?ছাত্র: বিয়ে করে পরিবার গঠন করব।এটি একটি কৌতুক। কিন্তু যদি এখানে ছাত্রের বদলে ছাত্রী হয়। আর মেয়েটি যদি বলে সে বড় হয়ে কারও স্ত্রী হবে, সন্তানের মা হবে, শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করবে, সংসার করবে তাহলে আর এটি কৌতুক থাকে না। তখন এটি হয়ে যায় চরম বাস্তব। কারণ একটি মেয়ের জীবনের চরম ও পরম পাওয়া হচ্ছে বিয়ে করা। ‘বিয়ে করা’ও নয়, ‘বিয়ে হওয়া’। কারণ মেয়েটি বিয়ে ‘করে না’। তার ‘বিয়ে হয়’। সে একটি অবজেক্ট মাত্র।
Advertisement
আমাদের সমাজে কোনো মেয়েকে স্বপ্ন দেখতে নেই যে, সে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে, ব্যবসায়ী হবে, এভারেস্টজয়ী হবে, সাইকেলে বা নৌকায বিশ্বভ্রমণ করবে, দক্ষিণ মেরুতে অভিযান করবে কিংবা মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়বে। এই সমাজ মেয়েকে স্বপ্ন দেখতে দেয় না। ঢাকা শহরের গুটিকয় মেয়ে এইসব স্বপ্ন দেখলেও বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের মেয়েরা এমন স্বপ্ন দেখলে সেটা আকাশ কুসুম বলেই গণ্য হয়। কারণ এখনও বাল্যবিবাহ প্রবল প্রতাপে এই সমাজে রয়েছে। এই প্রতাপকে আরও শক্তি যুগিয়েছে সাম্প্রতিক বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা ২০১৭ এর ১৯ নম্বর বিধান যা বিশেষ বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কী লেখা আছে সেখানে? বলা হয়েছে ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতামাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’
পুরো বিধিমালাটি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে গেলেও এই একটি মাত্র বিধানের(১৯) বলে সকল মহৎ উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যেতে পারে। কারণ এই ক্ষেত্রে বাবা মা বা অভিভাবক সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে কত কম বয়সে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন তার কোনো ন্যূনতম বয়স বলা হয়নি। আর ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ কথাটিও যথেষ্ট গোলমেলে। কারণ একজন শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ কী? অন্ন , বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা।
কিন্তু বাল্যবিবাহের ফলে শিশুর স্বাস্থ্যহানি, ম্যারিটাল রেপের আশংকা, কমবয়সে মা হওয়ার কারণে মৃত্যুঝুঁকি এবং বিয়ের কারণে শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাহলে বিয়েটি কিভাবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করল? আরও একটি কথা। বিয়ে তো দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের পূর্ণ সম্মতিতে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে হওয়ার কথা। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে তো কোনো মানুষ কোনো আইনি চুক্তি করতে পারে না। তাহলে বিয়েটা হবে কিভাবে? কে কাবিননামায় সই করবে? এবং সেই সই কিভাবে বৈধতা পাবে?
Advertisement
এবার আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। বাণিজ্যিকধারার কয়েকটি চলচ্চিত্রের নাম দেখছিলাম। সেই সঙ্গে পোস্টারও। কয়েকটি টিভি নাটকও দেখলাম। আরও দেখলাম বেশ কয়েকটি সিরিয়াল। মনে হলো দেশে প্রেম ও বিয়ে বিষয়ক সমস্যা ছাড়া আর কোনো সমস্যাও নেই, কাজকর্মও নেই। যদিও এখন বলিউডে পিঙ্ক, দাঙ্গাল, মাতৃ এর মতো ছবি হচ্ছে যেখানে নারীর অধিকারের বিষয়টিকে তুলে ধরা হচ্ছে। আমাদের দেশেও বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে নারীর অধিকারের বিষয়গুলো উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালগুলো এখনও সেই প্রেম ও বিয়ের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব চলচ্চিত্র ও টিভিসিরিয়ালে প্রেমকে এত ওভার গ্লোরিফাই করা হয়, এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, বিয়েকে জীবনের এত চরম পাওয়া বলে দেখানো হয় যে কিশোর কিশোরীদের মনে হতেই পারে জীবনের চরম প্রাপ্তি হলো প্রেম ও বিয়ে।
আমাদের দেশে মিলনাত্মক চলচ্চিত্র মানে শেষে নায়ক নায়িকার বিয়ে বা বিয়ের পথে সকল বাধা অপসারণ। আর বিয়োগান্তক মানে নায়ক নায়িকার বিয়ে হলো না বা মৃত্যু হলো। অর্থাৎ তারা বিচ্ছেদের কারণে একত্রে জীবন পার করতে পারল না। সত্যিই কি তাই? সকল সুখের চাবিকাঠি কি প্রেম ও বিয়ে? বাল্যবিবাহের যাঁতাকলে পিষ্ট নারী জানে বিয়ের পর কিভাবে যন্ত্রণার শুরু হয়। কারণ ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল’ রুপকথার এই শেষ লাইনটি একেবারেই রুপকথা। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
গণমাধ্যমে এখন যেটা দরকার সেটি হলো প্রেম বিয়ে ইত্যাদিকে ওভার গ্লোরিফাই করা বাদ দিয়ে বরং জীবন সংগ্রাম, ক্যারিয়ার ও জীবনের সৃজনশীল কাজকে গ্লোরিফাই করা। বিশেষ করে নারীর। একজন নারী বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি, বা একজন নারী কর্পোরেট কর্মী তার পেশাগত টানাপোড়েন, তার লক্ষ্য, সাফল্য ব্যর্থতা এগুলো তুলে ধরা দরকার। দরকার বাল্যবিবহারে কুফল তুলে ধরে তথ্যচিত্র প্রচার। প্রতিটি সিনেমা হলে ছবি শুরুর আগে একটি ৫ মিনিটের তথ্যচিত্র দেখানো দরকার বাধ্যতামূলক ভাবে। টিভিস্ক্রল, টিভিসি প্রচার করা দরকার বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। এগুলো হলো গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম যা বাল্যবিবাহ রোধে মিডিয়ার কমিটমেন্টকে তুলে ধরবে।
আর সরকারের সত্যিকারের সদিচ্ছা প্রতিফলিত হবে যদি তারা ওই বিতর্কিত ১৯ নম্বর বিধানটি অবিলম্বে বাতিল করেন। বিয়ে নিয়ে বদ্দা বা ছোটদা কারও মাতার প্রয়োজন নেই। ‘চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে?/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে, সোনামণির বিয়ে’। এগুলো ছড়ার জগতেই ভালো। বাস্তবে সোনামণিদের হতে হবে বিশ্বজয়ী। বাল্যবিবাহের চক্রে তাদের কোনোভাবেই আটকে রাখা চলবে না।
Advertisement
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি