বিশেষ প্রতিবেদন

মিথ্যা বলার রাজনীতি অপছন্দ যুব সমাজের

সংসদ সদস্যদের বৃহত্তর ফোরাম ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকায়। এ উপলক্ষে বিশ্বের ১৩১টি দেশের পার্লামেন্ট সদস্যরা সমবেত হয়েছেন বাংলাদেশে। এ ফোরামে যুব এমপিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উগান্ডার ২৬ বছর বয়সী নারী এমপি অসরো মাউরিন। মঙ্গলবার জাগো নিউজের মুখোমুখি হন তিনি। কথা বলেন যুব নেতৃত্ব, রাজনীতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সিরাজুজ্জামান। ছবি তুলেছেন বিপ্লব দিক্ষিত।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনি যুব এমপিদের নিয়ে কাজ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কেমন?অসরো মাউরিন : ‘ইয়ুথ পার্টিসিপেশন ইন ন্যাশনাল পার্লামেন্ট ২০১৬’ এর গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০ বছরের কম বয়সীদের মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। আর ২০ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে ভোটার মাত্র ৫৭ শতাংশ। এত কমসংখ্যক ভোটার হওয়ার কারণে তরুণ-তরুণীরা ভোটার হতে আগ্রহী নন। তারা এখন ভোট দিতেও চান না। ১২৮টি দেশের সাংসদদের ওপর গবেষণা জরিপ করা হয়েছে। গবেষণায় বয়সসীমার তুলনামূলক চিত্রে দেখা গেছে, ৪০ বছরের নিচে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের নিচে ২৬ শতাংশ সাংসদ রয়েছেন, যা খুবই হতাশাজনক। বিশ্বে তরুণ সাংসদদের প্রতিনিধিত্বের হার বেশি সুইডেনে। সেখানকার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ সাংসদের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে।

এ তালিকায় ইকুয়েডর রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। দেশটিতে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ যুব এমপি। এছাড়া তৃতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড ১০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং চতুর্থ স্থানে নরওয়ের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ যুব এমপি রয়েছেন। আমেরিকা-ইউরোপ-আফ্রিকান দেশগুলোতে ৩০ বছরের কম বয়সী সর্বাধিক সাংসদ রয়েছেন। বিশ্বে তরুণ সাংসদদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৬০ : ৪০। জাগো নিউজ : আপনাদের গবেষণা অনুযায়ী যুবকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কম। কেন এ পরিস্থিতি?অসরো মাউরিন : রাজনীতিকরা প্রচুর মিথ্যা কথা বলেন। এছাড়া রাজনীতিকরা অনেক প্রতিশ্রুতি দেন যা বাস্তবসম্মত নয়, কিংবা বাস্তবায়ন করেন না। এ কারণে যুবদের কাছে একটা ভুল বার্তা চলে যায়। এতে তারা রাজনীতিতে আসতে নিরুৎসাহিত হন। তারা রাজনীতিকে অপছন্দ করেন। একজন এমপি হিসেবে আমাদের সবার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। রাজনীতির মানোন্নয়ন করতে হবে। কিন্তু দিনের পর দিন রাজনীতির মান কমে যাচ্ছে। রাজনীতিকরা অনেকে ভাল কাজ করেন। আর ভাল কাজ করার সুযোগও আছে। কিন্তু মিডিয়ায় বেশিরভাগ সময় এমপি কিংবা রাজনীতিকদের এমন নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে যে একজন রাজনীতিকের সব ভাল কাজ পেছনে পড়ে যায়। সামনে আসে শুধু নেতিবাচক কাজগুলো। এজন্য যুবরা সংসদে আসতে চান না। এটি আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

আবার এও দেখা যায়, শত শত যুবরা রাজনীতিতে আসতে চান। অনেকে সংসদ সদস্য হতে চান। কিন্তু কেউ তাদের সাপোর্ট করেন না। তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে অর্থ, ভোটারদের সাড়া পাওয়া, রাজনীতির মনোন্নয়ন নিশ্চিত করাসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : যুবদের কেন রাজনীতিতে কিংবা সংসদ সদস্য হিসেবে আশা উচিত বলে আপনি মনে করেন?অসরো মাউরিন : কেউ যদি দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবেন এবং তাদের জন্য কাজ করতে চান তাহলে অবশ্যই রাজনীতিতে আসা উচিত। তরুণরা রাজনীতির পরিবেশ পছন্দ করেন। কিন্তু তারা যদি এগিয়ে না আসেন, পরিস্থিতি পাল্টাবে না।

জাগো নিউজ : আপনি একজন অবিবাহিত নারী এমপি। এ নিয়ে কখনও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে?অসরো মাউরিন : হ্যাঁ। এটা নিয়ে প্রায় আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু যারা আমাকে এ ধরনের প্রশ্ন করেন তাদের বলি, এটা নিয়ে আপনার ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আর আমার ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে আপনাকে ও আপনার পরিববার, এমনকি দেশ নিয়ে আমি বেশি চিন্তা করি। এরপর তারা এ বিষয়ে আর কিছু বলেন না।

জাগো নিউজ : একজন কম বয়সী এমপি হিসেবে আপনাকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে?অসরো মাউরিন : আমি মাত্র ৮ মাস আগে উগান্ডার এমপি নির্বাচিত হয়েছি। এর মধ্যে আমাকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত আমাকে কেউ কিছু জানাতে বা শেখাতে আগ্রহ দেখায়নি। আমাকে নিজ উদ্যোগে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কেও কেউ জানাতে চায়নি।

জাগো নিউজ : আমরা জানি যুবদের অনেকেই রাজনীতিতে আসতে চান। কিন্তু সেভাবে আসতে পারেন না। আবার কেউ কেউ এলেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। এর কারণ কী?অসরো মাউরিন : এজন্য মানুষের চিন্তাভাবনা দায়ী। মুলত তরুণ-তরুণীদের কেউ তেমনভাবে পাত্তা দিতে চান না। অনেকে ভাবেন তারা এখনও ভাল কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি। এ ধারণা বদলাতে হবে। তরুণরা অনেক কিছু করতে পারেন। কারণ তাদের চিন্তা-চেতনা আধুনিক ও বাস্তবসম্মত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া সমাজে উন্নয়ন সম্ভব না।

Advertisement

জাগো নিউজ : যুবরা এমপি হতে চাইলে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কোনো বাধা আসে কী?অসরো মাউরিন : অবশ্যই অনেক বাধা আসে। প্রথমত, দল তাদের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দিতে চায় না। নিজ দেশের বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি তুলে ধরে আমি বলতে পারি, সেখানে ১৮ বছর বয়সে সবাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়। কোনো অপরাধ করলে তাকে সাজার আওতায় এনে প্রয়োজনে জেলেও পাঠানো হয়। কিন্তু একই বয়সে কাউকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে না। সুখের বিষয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ইয়াং উইং থাকে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে তরুণরা নিজেদের তৈরি করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নিতে পারে।

জাগো নিউজ : ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে তারা কোনো বাধার সম্মুখীন হন কী?অসরো মাউরিন : তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে অর্থ, ভোটারদের সাড়া পাওয়া, রাজনীতির মনোন্নয়ন নিশ্চিত করাসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো সামাজিক সমস্যা।

জাগো নিউজ : আপনি অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এমপি হয়েছেন। এমপি হওয়ার পর এখন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী?অসরো মাউরিন : প্রথমে তো অনেকে হাসাহাসি করেছেন। আমি অবিবাহিত বলে অনেকে প্রশ্নও তুলেছেন। যারা প্রথমে আমাকে বাধা দিয়েছিলেন, তারাই এখন উৎসাহ দিচ্ছেন। আজ অনেক তরুণই আমাকে তাদের আইডল ভাবছে। তারা এখন আমার মতো হতে চাইছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করার জন্য দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পাওয়া খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এমপি হওয়ার পর অনেক কাজ করার থাকে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। সাধারণত তরুণ-তরুণীদের বেশি টাকা থাকে না। তাদের বেশি পরিচিতিও থাকে না। তাই যত যোগ্যই হোক, সাধারণ মানুষ তরুণদের এমপি হিসেবে চিন্তা করতে পারেন না।

জাগো নিউজ : আমাদের দেশে অনেক তরুণ এমপি রয়েছেন, যাদের অধিকাংশের বাবা কিংবা মা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এজন্য তারা এমপি হতে পেরেছেন। আপনার ক্ষেত্রে কি একই ঘটনা ঘটেছে?অসরো মাউরিন : না, না। আমাদের বংশে কেউ রাজনীতি করেন না। আমিই প্রথম রাজনীতিতে আছি এবং এমপি হই।

জাগো নিউজ : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।অসরো মাউরিন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

এইচএস/এসআর/এআরএস/পিআর