সলিম হাজী অনেকক্ষণ জাকিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে বিরক্তি। তারপর কিছু না বলে পাণ্ডুর মুখ নিয়ে অন্যত্র সরে গেলেন। প্রতাপশালী বাবাকে এমনভাবে নিভে যেতে দেখে জাকিরও একটু বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জাকিরের মনের ভেতরে নামে ভয়ের কালো আঁধার।
Advertisement
জাকিরের বাবা ভয়ংকর রাগী মানুষ। বদমেজাজী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জাকির বাবাকে বাঘের মতো ভয় পায়। শুধু জাকিরই না, পরিবারের সবার মধ্যেই সবসময় তাঁকে নিয়ে ভীতি কাজ করে। আজকেও জাকিরের মনের মধ্যে সেই পুরনো ভীতি জেগে উঠেছে।
সকালের নাস্তা খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে জাকির বাজারে গিয়েছিলো। বাড়িতে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় সলিম হাজী তাকে ডেকে নেন। তিনি বলেন, ‘আগামী জুম্মাবার পাশের গ্রামের আমার চাচতো ভাই আ. করিম মোল্লার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে।’
কথাটি শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় জাকিরের। বলা নেই- কওয়া নেই, বিয়ে। বললেই হলো, চেনা-জানা নেই, তাকে বিয়ে করতে হবে। জাকির সলিম হাজীকে জানায়, সে এ বিয়েতে রাজি না। বিস্মিত চোখে কারণ জানতে চায় সলিম হাজী।জাকির বলে, ‘আমার পড়াশোনা কেবল শেষ হয়েছে। এখন চাকরির চেষ্টা করবো। আগে কিছু করে নেই। তারপর...’জাকির কথা শেষ করতে পারে না। সলিম হাজী বলেন, ‘আমি করিম মোল্লারে কথা দিয়েছি। তার মেয়ের সঙ্গে ছোটবেলায়ই তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। করিম মোল্লা অসুস্থ তাই ও চাচ্ছে...’ জাকির এবার গর্জে ওঠে। ‘আপনি বললেই হবে নাকি! বড় ভাইয়েরা রয়েছে, তাদের বিয়ে দেন। আমাকে কেন?’সলিম হাজী আবারও বলেন, ‘করিম মোল্লার শরীর খারাপ। যহন-তহন যায় যায় অবস্থা। তুমি প্রস্তুতি নেও, সামনের জুম্মাবারেই তোমার বিয়ে হবে।’জাকির এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। তাঁকে বলে দেয়, ‘আমি এখন নাবালক নই। আপনি যা বলবেন তা-ই আমাকে মানতে হবে? আপনি আমাকে না জানিয়ে কী করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন? একবারও আমার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আপনি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে চাইছেন?’আমি তোমার জীবন নষ্ট করে দিতে চাইছি!চাইছেনই তো। যার সঙ্গে বিয়ের কথা বললেন, সেই মেয়ে অষ্টম শ্রেণি পাস! সে কি আমার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারবে?তোমার মা-ও কিন্তু পড়াশোনা জানে না। সেইদিন এখন আর নেই আব্বা। আপনি চাইলেই আমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারেন না। বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বলে জাকির। সলিম হাজী ভারাক্রান্ত মনে শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার বিয়ে করতে হবে না।’সলিম হাজী ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।
Advertisement
জাকিরের এমন ব্যবহারে পরিবারের সবাই একটু হকচকিয়ে যায়। সবার মুখ কালো মেঘের মতো থমথমে ভাব। জাকিরের মনের ভেতরেও অনুশোচনার জন্ম হয়। সে এমন ব্যবহার না করলেও পারত। শত হোক সে তার বাপ। মনে হয় অনেক কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু সে কী করবে? তিনি যা বলেছেন, তা-ও তো মেনে নেওয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করা জাকির গত তিনদিন আগে বাড়িতে আসে। তার বড় দুই ভাইও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। ছোটবোনটি সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে। বিশাল সম্পত্তির অধিকারী সলিম হাজীও পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মানুষ। শুধু জাকিরের মা আকাশী বেগমের স্বাক্ষরজ্ঞান আছে। তারপরও সাংসারিক কাজকর্ম ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পেছনে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি।
জাকির ভাবে, বিকালে আব্বা আছরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরলে তার কাছে মাফ চেয়ে নেবে।
কথায় আছে, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। জাকিরের ভাগ্যও সেই চক্রে বন্দি হয়। দুপুরের পরপরই সলিম হাজীর বুকে ব্যথা ওঠে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মারা যান। সারাবাড়িতে নামে শোকের মাতম। আশেপাশের পরিচিতজন, প্রতিবেশি আর আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে বাড়িতে পা ফেলা দায়। জাকিরের অবস্থা তখন বেগতিক। তার মনে বাজতে থাকে, তার দেয়া কষ্টের কারণেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। সে অপরাধীর মতো বাড়ির এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে।
Advertisement
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে। এশার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সলিম হাজীকে দাফন করা হয়। সবাই ফিরে যায় যার যার বাড়িতে।
রাত গভীর হয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জাকিরের মনের কষ্ট। সারারাত জাকিরের ঘুম হয় না। ভোরবেলা ভাইদের সঙ্গে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়। নামাজ শেষে বাবার কবর জিয়ারত করার সময় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দেয়। বাসায় এসে আগের মতোই জাকির নিজেকে ঘরের ভেতর বন্দি করে রাখে। কারো সঙ্গে দেখা করে না, কথা বলে না। সবাই নানাভাবে বোঝায়। শুধু একজন এর ব্যতিক্রম, আকাশী বেগম। তিনি জাকিরের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলেন না। পরিবারের অনেকেই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছে, তবে এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি।
এক সপ্তাহ পর জাকির তার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেলে আকাশী বেগম। জাকিরের হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে। আকাশী বেগমের মনের ভেতরের; চাপা পড়া আগুনের মতো দগদগে অভিমানের ছোঁয়া পেয়ে জাকির ভেঙে পড়ে। দৌড়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু চারটি চোখ দিয়ে বইতে থাকে জলের ধারা।
কথায় আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই মানিয়ে নিতে শেখে মানুষ। সলিম হাজীর পরিবারও তার মৃত্যুকে ভুলে জীবনের পথে হাঁটতে থাকে। শোক অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। শুধু অপরাধ বোধে কুণ্ঠিত হয়ে জাকির ঘরে বন্দি পড়ে রয়। নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না পিতার আকস্মিক মৃত্যুর জন্য।
সলিম হাজী মারা গেছেন প্রায় ছয় মাস। জাকিরও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সেদিন ছিলো শুক্রবার, দুপুরে জুম্মার নামাজ পড়ে বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে সে বাড়িতে আসে। খেয়েদেয়ে একটু ঘুম দেবার আশায় বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
কিছুদিন ধরে শহরে চলে যাওয়ার জন্য জাকিরের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তার পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে, ভালো মতো পাস করেছে। এখন চাকরির চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের সবাই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। বাড়িতে থাকলে সারাদিন মনমরা করে থাকে, তার চেয়ে শহরে গিয়ে নতুন পরিবেশে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারবে ছেলেটা।
দুপুরের ভাতঘুমে জাকির সলিম হাজীকে স্বপ্ন দেখে। সলিম হাজী আর সে একটি বিশাল মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এক সময় নীরবতা ভেঙে জাকির সলিম হাজীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আব্বা ওইদিন আমার ব্যবহারে আপনি অনেক কষ্ট পাইছিলেন; না? বিশ্বাস করেন, আমি ইচ্ছা করে আপনের মনে দুঃখ দেই নাই। কথাগুলো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আপনে আমারে মাফ কইরা দেন আব্বা!’
প্রত্যুত্তরে সলিম হাজী একটি কথাও বলেন না। তিনি হেঁটে চলেন। তাঁর পেছনে পেছনে কাতর অনুনয় করতে করতে হেঁটে চলে জাকির। এক সময় সলিম হাজী তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বাড়ি যা, আমার কাম আছে, উত্তর পাড়ার বশিরের লগে দেখা করতে হইবো।’
জাকিরের ঘুম ভেঙে যায়। তার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে থাকে। সে সিদ্ধান্ত নেয়- দ্রুত এই বাড়ি ত্যাগ করতে হবে। আগামীকাল ভোরেই সে ঢাকায় চলে যাবে।
মানুষের জীবনে যখন দুঃসময় আসে, শত চেষ্টা করেও মানুষ তার থেকে মুক্তি পায় না। সন্ধ্যার পর দুঃসময়ের সমন নিয়ে বশির ব্যাপারি সলিম হাজীর বাড়িতে এসে হাজির হয়। শোনায় অদ্ভুত এক ঘটনা।
বিকালে বাড়ির পাশের ক্ষেতে বশির লালশাকের চারা পরিচর্যা করছিলো। হঠাৎ সাদা জোব্বা পরা একটি লোক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা তুলে তাকাতেই ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে। সলিম হাজী সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে হাতের ইশারায় পূবের দিকে কী যেন দেখায়! বশির সেদিকে তাকায়, তারপর আবার সলিম হাজীর দিকে তাকাতেই দেখে, সব ফাঁকা, কেউ নেই। ভয় পেয়ে হাতের নিড়ানি ফেলে বশির দৌড়ে বাড়িতে চলে যায়। তিনি বলেন, ‘পূবধারে যেদিকে আপনেগো জমি আছে, হাজীসাব হেই মুখিই হাত তুলে ইশারা করছে।’
ঘটনাটি শুনে কেউ কোনো কথা বলে না। এ ওর মুখের দিকে তাকায়। এমন কথায় সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয় জাকির। দুপুরের ভাতঘুমে সলিম হাজী তাকে যে কথা বলেছেন, তা সত্যি হয়ে যাওয়ায় জাকির শুধু বিস্মিতই নয়- রীতিমত ভয় পায়।
এদিকে এক কান দু’কান করে ঘটনাটি পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বলতে থাকে, ‘হাজী হলে কী হবে, বড়লোক মানুষের সব টেকাপয়সা কি আর হালাল পথের আয়! মনে হয় তার পূবের জমিতে কোনো ঘাপলা আছে। এখন কবরের আজাবে পইড়া বশিররে দিয়া যার জমি তারে ফিরাইয়া দিতে কইতাছে।’ মসজিদের ইমামসাহেবও সফিককে এমন কথা বলেছেন। একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।
পরদিনই সফিক সদরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ওই জমির ইতিহাস তুলে আনেন। সলিম হাজী চল্লিশ বছর আগে জব্বার মুন্সী নামে এক লোকের কাছ থেকে জমিটি কিনেছিলো। কিন্তু জব্বার মুন্সীকে গ্রামের কেউই চেনে না। গ্রামের কেউ কিছুই বলতে পারে না।
সংকট আরো ঘণীভূত হয়। একদিন সকালে জেলেপাড়ার বিশ্বনাথ জাউলা কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। সফিকের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমারে বাঁচান ভাইজান, আমারে বাঁচান।’ সফিক সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। আকাশী বেগম উঠানে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথের কথা শুনছিলেন। তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গত সোমবার ভোররাতে বিশ্বনাথ পূবধারের পাশের বিলে মাছ ধরছিলো। হঠাৎ দেখে, নৌকার মাথায় সলিম হাজী বসে আছে। হুবহু বশির ব্যাপারীর বর্ণনার মতো, তাকেও ওই জমির দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে কিছু দেখিয়েছে। তবে বিশ্বনাথকে ওই জমির দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বলেছে, ‘সাবধান, ভারি বিপদ!’
এরমধ্যে আরো তিনজনের নাম যুক্ত হয়েছে, যাদের সলিম হাজী দেখা দিয়েছে। পূবের জমির দিকে হাত তুলে ইশারা করে সাবধানবাণী শুনিয়েছেন।
পীর-হুজুর, ঝাড়-ফুঁক অনেক কিছু্ করা হলো। কিছুতেই কিছু হয় না। কেউই সলিম হাজীর সাবধানবাণীর কোনো অর্থ বের করতে পারে না।
দিন যত যায়; সমস্যা তত বাড়ে। গ্রামের যত্রতত্র মানুষ সলিম হাজীকে দেখতে শুরু করেছে। নানান মুখরোচক গল্পের উৎপাদন করে গ্রামখানা সলিম হাজীর নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। প্রতিদিন নিত্যনতুন গল্প আর অগণিত মানুষের আগমনে সলিম হাজীর বাড়িতে এক হুলস্থুল কারবার শুরু হয়। তবে জাকির একটি বারের জন্যও ঘর থেকে বের হয়নি।
আঠারো দিন পর গ্রামের বড় রাস্তায় এক ফকিরের আগমন ঘটে। মাথায় জটা, গায়ে লালসালু, কাঁধে ঝোলা, একহাতে ত্রিশূল, আরেক হাতে মালশা। দেখলেই মনে হয় সিদ্ধপুরুষ। তিনি আস্তানা গাড়েন সলিম হাজীর পূবের জমিতে। এই খবর চারপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই পূবের চকের জমিকে বেষ্টন করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। উৎসুক জনতা নানান কথায় তাদের শঙ্কা আর ভয় প্রকাশ করতে থাকে। এতো মানুষ দেখে ফকির বিস্মিত। বুঝে উঠতে পারছেন না, এরা কেন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে! তার মনে ভয়ের রেশ। তবে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে যেভাবে ছিলেন সেভাবেই বসে রইলেন।
উপস্থিত জনতার কেউ এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। এলাকার মুরুব্বিরা মসজিদের ইমামকে নিয়ে এসেছেন। ফকিরকে দেখেই ইমাম ফতোয়া দেন, ‘এইটা একটা বদ্ধ উন্মাদ! দেখলেই মনে হচ্ছে বেদাতি কাজকর্ম করে! এর সঙ্গে কথা বলাও ঠিক না।’ তিনি চলে যান। অনেকে নানানভাবে বুঝিয়েও তাকে ধরে রাখা যায় না।
দুপুরের পর সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। তার নরম রোদ চারদিকে লুটোপুটি খাচ্ছে। শীতের আগমনী বিকালে উৎসুক জনতার উপস্থিতি এখন মহাসমুদ্রের মতো। এক সময় ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় সফিকের। সে এগিয়ে এসে মুরুব্বিদের বলে, ‘আপনারা যদি কেউ আসতে চান, তাহলে আসেন। না হলে আমি একাই গিয়ে ফকিরের সঙ্গে কথা বলবো।’
সফিক ও গ্রামের তিনজন বয়স্ক মানুষ ফকিরের সঙ্গে কথা বলতে গেল। চারদিকের জনতার মধ্যে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। সব শুনে ফকির মুচকি হাসে। আকাশের দিকে তাকায়, চারপাশ দেখে। তারপর বলে, ‘সবাই সন্ধ্যার আগেই এই স্থান ত্যাগ করেন। আর অন্ধকার হলে কেউ ঘরের বাইরে বের হবেন না। ঘরে থাকবেন। কোনো মহিলা যেন আজ রাইতে তার চুল খোলা না রাখে। কোনো অবিবাহিত যুবতী যেন কোমড়ে বাইট্টা ছাড়া না থাকে। যান তাড়াতাড়ি সকলে চইল্লা যান। সময় কম।’
ফকিরের আগমনে মুখরোচক গল্পের ইতি দেখতে আশেপাশের গ্রামের অনেকেই এসেছিলেন। তারা অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরে যেতে পারবেন না বুঝে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন। পুরো গ্রাম সন্ধ্যার আগেই নিস্তব্ধ। শুধু পূবের চরে সলিম হাজীর জমিতে ধূপধুনা জ্বেলে ফকির একা বসে আছে।
একটু একটু করে রাত গভীর হয়। ফকিরের কথা মেনে সবাই যে যার ঘরে দরজা এঁটে বসে আছেন। কারো চোখে একফোটা ঘুম নেই! খাওয়া দাওয়ার কোনো বালাই নেই। সবাই শুধু গত আঠারো দিন ধরে চলা একটি বিষয়ের পরিণতি দেখতে চায়।
ফকিরের আগমন সংবাদ পেয়ে সবচেয়ে বেশি মুষরে পড়ে জাকির। দুপুরের পর থেকে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
রাত তখন আনুমানিক একটা। জাকিরের অস্থিরতা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে। সে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাইছে। কেউ বাধা দিয়েও আটকে রাখতে পারছে না। শেষে তার ঘরে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
এক সময় পারুল ওই ঘরে গিয়ে জাকিরকে না দেখে গলা ফাটিয়ে মা বলে চিৎকার দেয়। সবাই ছুটে এসে দেখে জাকির নেই। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ভেতরে কারো মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। সবাই আল্লাহর নাম নিতে নিতে ভোরের অপেক্ষা করতে থাকেন।
আতঙ্কিত রাত শেষে সূর্যের আলোর আভা দেখা মেলে। একটি নতুন দিন শুরুর ঘোষণা দিয়ে ধীরে ধীরে পূবের আকাশে উদিত হয় সূর্য। ভয়াবহ রাতের সংঘটিত নাটকের শেষ দৃশ্য দেখতে গ্রামের সবাই পূবের চরে সলিম হাজীর জমির সামনে উপস্থিত হয়।
বিশাল খোলা মাঠের উপর ধীরে ধীরে বইছে হেমন্তের কুয়াশা। কুয়াশার ফাঁক গলে বিস্তীর্ণ চর একটু দেখা যায়, আবার যায় না! কুয়াশা ভেদ করে একজন একজন করে সবাই এগিয়ে যায় সলিম হাজীর জমির দিকে।
সলিম হাজীর জমিতে দু’জন মানুষ পড়ে আছে। তাদের দেহ রক্তাক্ত। জাকিরের পেট চিড়ে আছে, ফকিরের পেটে ঢোকানো ত্রিশূল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক জিনিসপত্র। ম্তম্ভিত সবাই অপলক চেয়ে থাকে। ঘোর কাটে না।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয়- জমিটিতে ছোট ছোট অনেক গর্ত করা। আর দু’জনের লাশের সামনে কাপড় দিয়ে একটি মুখবাঁধা পিতলের কলস পড়ে আছে।
উপস্থিত জনতার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। কী আছে কলসিতে? গুপ্তধন না কি অন্যকিছু!
এলাকার বৃদ্ধ মোতলেব এগিয়ে যান। কলসটি হাতে নিয়ে তার মুখের কাপড়টি খুলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত একটি উৎকট গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কলসি উপুড় করলে সেখান থেকে বের হয়ে আসে দলা দলা মনুষ্য বিষ্ঠা।
এসইউ/পিআর