বিশেষ প্রতিবেদন

চার হাজির নিয়ন্ত্রণে খেজুর বাজার

দেশে খেজুরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন পুরান ঢাকার চার ব্যবসায়ী। তারা হলেন- সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, হাজি বরাত মিয়া, হাজি সিরাজুল ইসলাম ও হাজি আফসার উদ্দিন। হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বর্তমানে দেখভাল করছেন তার ছেলে সোলাইমান সেলিম। 

Advertisement

খেজুর আমদানি করে দেশে আনা এবং বাজারে সরবরাহ পুরো প্রক্রিয়া নির্ভর করে এই চার ব্যবসায়ীর ওপর। বাদামতলীর খেজুর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব খেজুর পাওয়া যায় তা সরবরাহ করা হয় বাদামতলী আড়ত থেকে। এ আড়ত থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পাইকারি ব্যবসায়ীরা খেজুর সংগ্রহ করেন। তবে মাঝে মধ্যে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও বাদামতলী থেকে খেজুর সংগ্রহ করেন।

বাদামতলীতে খেজুরের আড়তদার ৫০ জনের মতো। তবে বিদেশ থেকে খেজুর আমদানি করেন মূলত ওই চার ব্যবসায়ী। তাদের ওপর নির্ভর করতে হয় বাদামতলীর আড়তদারদের। ফলে বাজারে খেজুরের সরবরাহ কত হবে এবং দাম কেমন হবে- তা পুরোপুরি নির্ভর করে পুরান ঢাকার প্রভাবশালী এ চার ব্যবসায়ীর ওপর। দুবাই ও ভারত থেকে মূলত তারা খেজুর আমদানি করেন। অভিযোগ আছে, আমদানি করা এসব খেজুরের মান একেবারে নিম্নমানের।

Advertisement

জানা গেছে, সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে সাধারণত কোনো খেজুর আসে না। সৌদি থেকে যদি প্রকৃত খেজুর আমদানি করা হয় তবে বাংলাদেশে ওই খেজুরের পাইকারি দাম দাঁড়াবে প্রতি কেজি হাজার টাকার উপর। বর্তমানে দেশে যে খেজুর পাওয়া যাচ্ছে এর মধ্য সব থেকে ভালো খেজুরটির প্রতি কেজি পাইকারি দাম ২০০ টাকারও নিচে।

আমদানি করা পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ঢাকায় চলে আসে। আবার কিছু কিছু চালানের খেজুর চলে যায় চট্টগ্রামের কাপ্তানবাজারে। তবে খেজুর ঢাকায় আসুক বা চট্টগ্রামে থাকুক এর মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে ওই চার ব্যবসায়ীর হাতে। কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ীরা মূলত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, বরাবরের মতো এবারও রমজান মাস সামনে রেখে রোজার অন্যতম প্রধান পণ্য খেজুরের মজুদ ও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়ে গেছে। যে কারণে রোজা শুরু হতে এখনও প্রায় আট সপ্তাহ বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে খেজুরের দাম এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়েছে।

রাজধানীর বাদামতলী বাজারে বর্তমানে ১০ কেজির এক কার্টন নাগাল খেজুর বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়, যা জানুয়ারিতে ছিল হাজার টাকার মধ্যে। প্যাকেট করা খালাস খেজুর এক হাজার ৬০০ টাকা এবং প্যাকেট ছাড়া খালাস খেজুর এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ খেজুরের দামও কার্টনে (১০ কেজি) প্রায় ২০০ টাকা বেড়েছে।

Advertisement

এছাড়া দাবাস খেজুর এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ২৫০ টা¬কা, বরই খেজুর এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, রেজিস খেজুর এক হাজার ২৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, জাহিদি খেজুর ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা কার্টন বিক্রি হচ্ছে। আর পাঁচ কেজি খুরমা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকায়। ১০ কেজির কার্টনের প্রতিটি পদের খেজুরের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। আর পাঁচ কেজির খোলা খুরমা খেজুরের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাদামতলীর একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, খেজুরের ব্যবসা করতে ওই চারজনের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমদানি করা খেজুরের বড় একটি অংশ মজুদ করা হয় চকবাজারে অবস্থিত হাজী সেলিমের নিজস্ব কোল্ড স্টোরেজে। বাজারে কখনও খেজুরের সংকট দেখা দিলে ওই চার আমদানিকারককে বললে তারা তাদের সংগ্রহশালা থেকে সরবরাহ করেন অথবা আমদানির উদ্যোগ নেন। তাদের ছাড়া নতুন করে কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে খেজুর আমদানি করা সম্ভব নয়।

সালমা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. নাইম জাগো নিউজকে বলেন, খেজুর সাধারণত রোজা শুরুর মাস তিনেক আগে আমদানি শুরু হয়। আর রোজা শেষ হয়ে গেলে ছয় থেকে সাত মাস খেজুর আমদানি বন্ধ থাকে। তবে আমাদের কাছে সব সময় খেজুর পাওয়া যায়। যখন যে খেজুরের সংকট দেখা দেয় আমরা আমদানিকারকদের কাছে বললেই তারা সরবরাহ করেন। যদি তাদের কাছে ওই খেজুর মজুদ থাকে তাহলে সেখান থেকে সরবরাহ করেন অথবা নতুন করে আমদানির ব্যবস্থা নেন।

আসছে রোজা উপলক্ষে খেজুর আমদানি শুরু হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকেই খেজুর আমদানি হচ্ছে। তবে জানুয়ারির তুলনায় এখন দাম একটু বেশি। প্রতি কার্টনে ২০০ টাকার মতো দাম বেড়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ খেজুর আসছে দুবাই থেকে।

মানিক এন্টারপ্রাইজের কর্মী মো. সুমন বলন, বাদামতলীতে খেজুর বিক্রি হয় এমন প্রতিষ্ঠান ৫০টির মতো। আমদানিকারকদের কাছ থেকে খেজুর সংগ্রহ করে তারা বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন। বর্তমানে যেসব খেজুর পাওয়া যাচ্ছে এর মধ্যে সব থেকে ভালো খেজুর হলো খালাস। ১০ কেজির এক কার্টন খালাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকায়। জানুয়ারিতে এ খেজুরের দাম ছিল এক হাজার ৪০০ টাকা। শুধু খালাস নয়, জানুয়ারির তুলনায় বর্তমানে সব ধরনের খেজুরের দাম ২০০ টাকা বেড়ে গেছে।

যোগাযোগ করা হলে খাজা ফ্রুট স্টোরের মালিক ও খেজুর আমদানিকারক হাজি বরাত মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘খেজুরে কোনো সিন্ডিকেট নেই। এখন ওপেন মার্কেট, যে কেউ খেজুর আমদানি করতে পারেন। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর আমরা চারজন শুধু খেজুর আমদানি করি এমন কথাও ঠিক নয়। চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেটের ব্যবসায়ীরাও খেজুর আমদানি করেন। তবে বড় আর ছোট। ছোটগুলো চোখে খুব একটা পড়ে না, এই হলো ব্যাপার।’

জানুয়ারির তুলনায় সব ধরনের খেজুরের কার্টনে প্রায় ২০০ টাকা দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন খেজুরের কিছুটা সংকট রয়েছে, এজন্য দাম কিছুটা বাড়তি। রমজান সামনে রেখে খেজুরের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে এমন অভিযোগ সঠিক নয়।’

মদিনা ফ্রুটের মালিক হাজী সেলিম ও তার ছেলে সোলাইমান সেলিম এবং সাথী ফ্রেস ফ্রুটের মালিক হাজি সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যোগাযোগ করা হলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কমোডিটি বিজনেসের নিয়ন্ত্রণ থাকবে চার-পাঁচজনের হাতে, এটাই স্বাভাবিক। এ চার ব্যবসায়ীর হাত ধরেই তা চার হাজার ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাবে। জাহাজ বোঝাই করে মাল আনা সবার পক্ষে তো সম্ভব নয়।’

এমএএস/এমএআর/জেআই্এম