মতামত

আনু কলা খায়!

জঙ্গিবাদের উত্থানকে এদেশে বিতর্কিত করার কৌশলটা এই মুহূর্তে অভিনব এবং এর পেছনে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত মুখ।

Advertisement

প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে যে, কেন জঙ্গিবাদকে অস্বীকার করার এই প্রবণতা? প্রাথমিক ধারণায় এর উত্তরে লক্ষ্য করা যায় যে, তারাই মূলতঃ এদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে অস্বীকার করছেন যারা সরকার-বিরোধী রাজনীতি করেন কিংবা সরকারের কর্মকাণ্ডকে যারা মনে করেন অবৈধ। সে বিচারে এই পক্ষটি আসলে জঙ্গিবাদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সরকারকেই দায়ী করেন এবং একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ নির্মূলের দায়িত্বও আসলে সরকারের হাতেই সঁপে দেন। মোটকথা, সবকিছুর দায় ও দায়িত্ব সরকারের, তারা শুধু বসে বসে ‘আঙুল চুষবেন’ আর সমালোচনা করবেন। বার বার গলার রগটি ফুলিয়ে বলবেন যে, জঙ্গিবাদ আসলে নাটক এবং এই নাটকের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে অথবা জঙ্গিবাদের বায়োস্কোপ দেখিয়ে সরকারকে জনগণকে বোকা বানিয়ে চলছে অনবরত।

আরেক শ্রেণির ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যে বা যারা মূলতঃ নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়টি গোপন রেখে চলেন কিন্তু জনগণের মনে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে যে আসলে তারা কোন পক্ষ। তারা জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সরকারের অবস্থানকে নস্যাৎ করার জন্য নানাবিধ যুক্তি হাজির করেন এবং তাদের সমর্থকগোষ্ঠির মধ্যে সেটি ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ভিত্তিক প্রচারণা চালান। তাদের ফেসবুক পাতায় যদি যান তাহলে দেখবেন যে, তাদের সমর্থনকারীরা মূলতঃ বাঁশের কেল্লার মতো ধর্মীয় উস্কানিদাতাগোষ্ঠি, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী এবং সে কারণেই শেখ হাসিনার সরকারের তীব্র বিরোধী।

এ পক্ষের তাত্ত্বিকগণ অবশ্য বলতে চাইবেন যে, তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কেউ যদি এগিয়ে আসে তাহলে সমর্থকদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিশ্বাসের দায় তারা কেন নেবেন? যুক্তি ফেলনা নয়, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যারা মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও এদেশের রাজনীতিতে একটু সেক্যুলার চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তারা কোনো ভাবেই এই তাত্ত্বিকদের জঙ্গিবাদ-বিরোধী প্রচারণায় বিশ্বাস করে না বরং তারা মনে করেন যে, এই তাত্ত্বিক এ্যাকটিভিস্টদের কারণেই এদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের ভয়াবহ দানব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কারণ এদের কারণেই এই দানব এক ধরনের বৈধতাও পেয়ে যাচ্ছে এদেশে।

Advertisement

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরেই এরকমই একজন তাত্ত্বিক এ্যাক্টিভিস্টের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। তিনি জোর সন্দেহ প্রকাশ করছেন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা জঙ্গিবিরোধী অপারেশন বিশেষ করে সিলেট ও মৌলভীবাজারে যে সকল জঙ্গি নিহত হয়েছে তারা আদৌ জঙ্গি কিনা সে প্রশ্ন তুলে। শুধু তাই-ই নয়, তিনি জঙ্গিবাদের উত্থানকে সরাসরি সরকারের সাজানো নাটক হিসেবে আখ্যা না দিয়েও একথাটিই বলেছেন যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদেরকে জঙ্গি হিসেবে হত্যা করেছে বলে দাবি করছে তারা মূলতঃ জঙ্গি নয়।

এমনকি জঙ্গি অপারেশন চলাকালে নিহত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও নাকি এক হিসেবে হত্যাই করা হয়েছে এই জঙ্গি দমনের নামে। অবশ্যই এই অভিযোগ ও অপবাধ ভয়ঙ্কর এদেশের জন্য। ভয়ঙ্কর এ কারণে যে, এরকম ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের সন্দেহ প্রচারিত হলে তা দেশের ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতা এক ধরনের সুযোগ লাভ করে এবং এই দানব দমনে সরকার ও জনগণের মিলিত প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ মিথ্যের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও জেগে ওঠে যে, তাহলে সত্য কে? এই তাত্ত্বিক এ্যাক্টিভিস্ট? নাকি সরকার?

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে সেটা এখন আর কোনো লুকোনো সত্য নয়, গত দুই দশক ধরে জঙ্গিরা বার বার তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। এদেশের গণমাধ্যমের অনেক রকম বদনাম রয়েছে কিন্তু জঙ্গিবাদ ইস্যুতে গণমাধ্যমের ভূমিকাটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়ই বলতে হবে। কারণ শুরু থেকেই তারা বিভিন্ন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট প্রকাশ করে প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও এর উত্থান একটি বাস্তবতা এবং রাষ্ট্রটি এই দানব দ্বারা আক্রান্ত। এমনকি জঙ্গিবাদকে যখন কেউ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে তখনও গণমাধ্যম তা ফাঁস করে দিয়েছে। বিশেষ করে কখনও কখনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে জঙ্গি দমনে তাদের সফলতা প্রমাণে কিছু সাজানো ঘটনার আশ্রয় নিয়েছে সে খবরও আমরা জেনেছি গণমাধ্যম থেকেই। কিন্তু তাই বলে এদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে নাটক বলে বা বায়োস্কোপ বলে ঢালাও ভাবে প্রচার করার প্রবণতাকে গণমাধ্যম কোনো ভাবেই সমর্থন করেনি।

আমরা গত দুই সপ্তাহে সিলেটে ও মৌলভীবাজারে ঘটা জঙ্গি অপারেশনের দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখি যে, এই জঙ্গিরা মূলতঃ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতেই ছিল এবং তাদের গতিবিধি নজর করেই এসব জায়গায় তাদের জঙ্গিতৎপরতাকে তারা চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়েছে। এই সক্ষমতা নিঃসন্দেহে অনেক সাধারণ নাগরিকের প্রাণ রক্ষা করেছে এবং দেশের ভেতরে একটি ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেছে, যেমনটি ঘটেছিল হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর। দেশের একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকে আজকের প্রধান শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারি যে, মৌলভীবাজারে যে সকল জঙ্গি নিহত হয়েছে তারা নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নতুন ভাবে সংঘঠিত হওয়ার চেষ্টাকালে তারা শিশুসহ নিহত হয়েছে এবং প্রতিটি শিশুর শরীরেই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের সরঞ্জাম সংবলিত ভেস্ত পরানো ছিল। শুধু তাই নয়, এই নারী জঙ্গিরা মোবাইল ফোনে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার আগে।

Advertisement

ওদিকে সিলেটের আতিয়া মহলকে এখনও সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি, কারণ এখনও সেখানে বিস্ফোরণ ঘটার মতো বিস্ফোরক রয়ে গেছে। আর সেখানে অভিযান চলাকালে র্যা বের গোয়েন্দা প্রধানসহ নিহতরা আসলে বাইরে থাকা জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আজকের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এতোটাই করিৎকর্মা যে তারা যে কোনো কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, এমনকি তারা ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর ছবি তুলে রাখতেও পারদর্শিতা অর্জন করেছে। ফলে প্রকাশিত যে কোনো রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হলে প্রশ্নকারীকে সেরকম আঁটঘাট বেঁধেই নামতে হবে।

যেমনটি একটু আগেই একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছি, যে দৈনিকটিকে কেউ সরকারের বন্ধু বলে মনে করা না, বরং তাকে সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক হিসেবেই মনে করা হয় এবং আলোচ্য তাত্ত্বিক/এ্যাক্টিভিস্টও এই পত্রিকাটিরই নিয়মিত একজন লেখক বটেন, তাদের রিপোর্টকে কোনো ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে তার পাল্টা তথ্য ও তথ্যের সপক্ষে প্রমাণাদিও থাকতে হবে। অথচ, এই তাত্ত্বিক/এ্যাক্টিভিস্ট সেরকম কোনো কিছুর ধার না ধেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্রচারণা ছেড়ে দিয়েছেন যেখানে তিনি প্রকাশ্যেই দেশের জঙ্গি তৎপরতাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং জোর গলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিহত সদস্যদের মৃত্যুকেও সাজানো বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। একজন দায়িত্বশীল মানুষের এই প্রবণতাকে আসলে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব সেটা আমার জানা নেই। তবে আগেই বলেছি এই প্রবণতায় তিনি একা নন, তিনি ও তার মতো অনেকেরই অবস্থান ও রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে ওপরেই ব্যাখ্যাটা দেওয়া হয়েছে। তবে এদের এই অস্বীকারের রাজনীতির আরেকটি ব্যাখ্যাও দেওয়া সম্ভব, সেটি দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানবো।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে উদার গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাজনীতির বিপক্ষে একটি স্রোতে সোচ্চারভাবে কাজ করে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে তাদের আরো বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে। তারা পোশাকে-আশাকে, আচরণে-আলোচনায় নিজেদের উদারপন্থী হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলেও মাঝে মধ্যেই তাদের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক চেহারাটি নখদন্তসমেত বেরিয়ে পড়ে। বিশেষ করে সেই সব সময়ে তারা নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে যখন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। যেমন জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশ দখল করে এদেশের রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে দেওয়া শুরু করেছিল তখন কিন্তু এদের মুখ থেকে কোনো প্রতিবাদের সুর শোনা যায়নি, এমনকি এরশাদও যখন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে প্রবর্তন করে তখনও তারা চুপ ছিলেন। চুপ ছিলেন কারণ তাতে তাদের কোনো অসুবিধে নেই বা ছিল না, তারাতো তাদের প্রগতিশীল চেহারাটি বজায় রাখতে পারছেন, সেটাতেই তারা আনন্দিত ছিলেন।

এমনকি শেখ হাসিনা যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার করছেন তখনও তারা চুপ থেকে কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেদেরকে প্রগতিশীল প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যদিও তখন যারা বুঝবার তারা এটুকুই বুঝেছেন যে, বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা আসলে কার পক্ষকে শক্তিশালী করছেন। গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে নাস্তিক-ইস্যুকে নিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা রাস্তায় নেমেছিল তখন এদের অনেকেই শেখ হাসিনার সরকারের বিরোধিতাকে নিজেদের ধর্ম জ্ঞান করেছেন। সেটা তাদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত অবস্থান, তাই সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু এই জঙ্গিবাদের উত্থান এখনই ঠেকানো না গেলে তারা অচিরেই যখন গোটা দেশকে দখল করার যুদ্ধ শুরু করবে তখন এই প্রগতিশীলতার পিরান দিয়ে কি তারা নিজেদের কল্লাটি রক্ষা করতে পারবেন? সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে এবং তোলা উচিতও। তবে আমি নিশ্চিত যে, দেশের ভেতর চলমান এই ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা নিশ্চয়ই এই আপাতঃ প্রগতিশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবর্গের সন্ধিহান বক্তব্য পাঠে বিপুল পুলক অনুভব করছে এবং তারা হাসতে হাসতে হয়তো একথাও বলছে যে, এরা আসলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘আনু কলা খায়’ অবস্থানেই আছে, চাপাতি-বোমা-গ্রেনেড-বন্দুকের সামনে পড়লে নিশ্চিত এই ‘কলা খাওয়া’ চেহারা বদলে যেতো, তখন আর এসব কিছুই নাটক বা বায়োস্কোপ বলে মনে হতো না, কোনো সন্দেহও আসলে থাকতো না যে, দেশে জঙ্গিবাদ আসলেই আছে এবং এই মুহূর্তে অন্য যে কোনো বিপদের তুলনায় জঙ্গি মোকাবিলাই সবচেয়ে বড় সমস্যা যা জাতীয়ভাবে মোকাবিলার প্রয়োজন রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/জেআইএম