বিশেষ প্রতিবেদন

পাটের পথে চামড়া!

ট্যানারি স্থানান্তরের নামে পাট শিল্পের মতো দেশের চামড়া শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন ট্যানারি মালিক ও শ্রমিকরা।

Advertisement

ট্যানারি মালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ, একসময় দেশের প্রধান অর্থ আয়ের উৎস ছিল পাট। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন কোনো বিশেষ দেশকে সুবিধা দিতে রফতানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহৎ খাত চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে।

তারা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে কোনোভাবেই ট্যানারির কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব নয়। হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ না দেয়া হলে চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসবে। মালিকরা ট্যানারির উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। আর ট্যানারির উৎপাদন একবার বন্ধ হলে বিদেশি বায়ারদের (ক্রেতা) হারাতে হবে। বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে  নেবেন। অন্যকোনো দেশ থেকে চামড়া কিনবে। সেক্ষেত্রে সব থেকে বেশি সুবিধা পাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।

এদিকে বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন) আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ট্যানারি মালিকরা। তারা বিসিকের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

Advertisement

ট্যানারি মালিকদের পক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিসিক আদালতকে জানায়, তারা সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইসিপি) দুটি মডিউল প্রস্তুত করেছে। ট্যানারি মালিকরা সাভারে না যাওয়ায় মেশিন দুটি নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সাভারে ৫০টি কারখানার বর্জ্য শোধনও সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি তারা অপরিশোধিত তরল বর্জ্যগুলো ধলেশ্বরী নদীতে ফেলছে। ফলে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ শিল্পকে ধ্বংসের দিকে অনেকটা নিয়েও যাওয়া হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকলে এ শিল্প ধ্বংস হতে বাধ্য। আমরা উৎপাদনে যেতে পারব না। আর উৎপাদন না হলে অবশ্যই ক্রেতা হারাতে হবে।’

‘হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ব্যবসা ও উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। আর উৎপাদন না হলে বায়াররা অন্য দেশে চলে যাবেন। চামড়া পাচার হয়ে যাবে। আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো’- বলেন শাহীন আহমেদ।

তিনি আরও বলেন, ‘৬ এপ্রিলের মধ্যে হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে আমরাই সহযোগিতা করব। কিন্তু আমাদের কিছু দাবি আছে। এগুলো সরকারকে জানানো হয়েছে। আমাদের দাবিগুলো মানতে হবে।’

Advertisement

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাটশিল্পের মতো দেশের ট্যানারি শিল্পকেও ধ্বংসের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশের চামড়া শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হবে ভারত।’

তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আদমজি জুট মিল বন্ধ করে দিয়ে কী লাভ হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক (বিশ্বব্যাংক) বাংলাদেশের জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদায় করে দেয়ার জন্য টাকা দিল। আর পশ্চিমবঙ্গের পাটকলগুলোর আধুনিকায়নের জন্য টাকা বরাদ্দ করল। ফলে সেখানে ব্যাপকহারে পাটকল গড়ে উঠল।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পাটও আমাদের দেশের কাঁচামাল, চামড়াও। পণ্যের দাম না পেলে কৃষক স্বাভাবিকভাবে পাটের উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। চামড়াও একধরনের কৃষিপণ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরাও উৎপাদন বন্ধ করে দেব। পাটশিল্প ধ্বংস করে এখন চামড়া শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। অন্য দেশকে সুবিধা দিতে এটি করা হচ্ছে।’

‘বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের উৎপাদন কমে গেলে ভারত সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে’ উল্লেখ করে আব্দুল মালেক বলেন, ‘চামড়া রফতানি করে ভারত সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশের ট্যানারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাবে। বর্তমানে ট্যানারি মালিকদের ১১শ কোটি টাকার এলসি খোলা আছে। উৎপাদন বন্ধ হলে বায়াররা তো (ক্রেতা) চলেই যাবে, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে ক্লেম (অভিযোগ) করবে। তখন আমাদেরই জরিমানা দিতে হবে।’

কাওসার ট্যানারির শ্রমিক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখনও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। গ্যাস না থাকলে উৎপাদন হবে কী করে? আবার সেখানে শ্রমিকদের থাকা ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে শ্রমিকরা কীভাবে কাজ করবে?’ এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় দেশের চামড়া শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে- বলেন তিনি।

এমএএস/এমএআর/পিআর