বিশেষ প্রতিবেদন

শ্রমিকদের আন্দোলনে নামানোর পাঁয়তারা ট্যানারি মালিকদের

রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নানা ফন্দিফিকির শুরু করেছেন ট্যানারি মালিকরা। এরই অংশ হিসেবে ট্যানারি শ্রমিকদের খেপিয়ে আন্দোলনে নামানোর পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ব্যানারে।

Advertisement

হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানার শ্রমিক ও ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।তারা জানান, শ্রমিকদের মাধ্যমে কীভাবে আন্দোলন করা যায় সে বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে সোমবার (৩ এপ্রিল) ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে বিশেষ বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই বৈঠকে ট্যানারি মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

এদিকে, একদিন আগেই রোববার আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজারীবাগের সব কারখানার কার্যক্রম আগামী ৬ এপ্রিল থেকে বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানায় সংগঠনের নেতারা।

কিন্তু এর ২৪ ঘণ্টা না যেতেই পরিকল্পিত শ্রমিক আন্দোলনের ছক কষতে শুরু করেছেন ট্যানারি মালিকরা।

Advertisement

আগামী ৬ এপ্রিলের মধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি বন্ধ করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, ট্যানারি মালিকরা হাজারীবাগ থেকে কারখানা সরাতে চান না। হাজারীবাগে ট্যানারির কার্যক্রম অব্যহত রাখতে যাতে মালিকদের ওপর আদালত অবমাননার দায় না আসে, সেজন্য শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

আন্দোলন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ট্যানারি মালিকরা আদালতের নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে হাজারীবাগের সব ট্যানারি বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে এমন তথ্য ছড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২ এপ্রিল ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ৬ এপ্রিলের মধ্যে হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পরিবেশ অধিদফতরকে সহযোগিতা করার ঘোষণা দেয়া হয়।সেইসঙ্গে বেশকিছু দাবিও তুলে ধরেন নেতারা। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) অনিয়ম ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করা, সাভারের চামড়া শিল্পনগরে দ্রুত গ্যাস সংযোগ দেয়া, বরাদ্দকৃত প্লটগুলোর মালিকানা বুঝিয়ে দেয়, হাজারীবাগের জমিতে ডিজাইন প্লান পাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা।

অপরদিকে, শ্রমিকরা যাতে আন্দোলনে নামেন সেজন্য বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের মধ্যে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে- হাজারীবাগ থেকে সাভারের মেহায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলে মালিকদের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে অর্ধেকের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন। মালিকদের নিরুপায় হয়ে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। ফলে হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানা বন্ধ করে দিলে শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

অভিযোগ উঠেছে, শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলন পরিকল্পনার পেছনে যারা ইন্ধন দিচ্ছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা হাইডেন ট্যানারির মালিক রশিদ ভূঁইয়া, ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেকসহ কয়েকজন প্রভাবশালী মালিক রয়েছেন।

Advertisement

ট্যানারি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হেমায়েতপুরে কোনো প্রতিষ্ঠানই পুরোপুরিভাবে কার্যক্রম শুরু করেনি। যারা ওখানে কাজ করছেন তারা সর্বোচ্চ ওয়েট ব্লু পর্যন্ত করছেন। কাঁচা চামড়া পাকা করার ক্ষেত্রে ওয়েট ব্লু হওয়া মানে ২৫ শতাংশের মতো কাজ সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ৭৫ শতাংশ কাজ এখনো হাজারীবাগেই হচ্ছে।

তারা জানান, কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, গ্রেডিং, ফিনিশিং, কেমিক্যাল দিয়ে ওয়েট ব্লু, প্রক্রিয়াজাত করার পর ভেজা চামড়া শুকানোসহ চামড়া পাকা করার সব প্রক্রিয়াই চলছে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে। এসব কাজ করতে যেসব ড্রাম ও মেশিন ব্যবহার করা হয় তার কোনোকিছুই সরিয়ে নেয়ার কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। অথচ ভারী ড্রাম ও মেশিন অন্য কোথাও সরাতে হলে কারখানার ভেতর থেকে বের করতেই এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, চাকরির নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব বিষয়ে বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ট্যানারি কারখানায় ৩০ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মরত আছেন। আর হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানার ওপর নির্ভর করে জীবিকা চলে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের। হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানার গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হলে ৫০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। শ্রমিকদের নানা সমস্যায় পড়তে হবে। কাজ না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে অনেক মালিক শ্রমিকদের বেতন আটকে দেবেন। কিন্তু কারখানা বন্ধ করে দেয়া হলে মালিকদের কোনো ক্ষতি হবে না।

ফিনিশ লেদার (চামড়া) সরবরাহ করা রবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রতিমাসে ৩০ হাজার বর্গফুট চামড়া সরবরাহ করি, এতে প্রায় ২৫ লাখ টাকার ব্যবসা করি। হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে দিলে আমার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিপদে পড়ে যাবেন। বিভিন্ন কোম্পানিতে বকেয়া পড়া টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের কাছে আমার ৪০ লাখ টাকার মতো পাওনা রয়েছে। এখন এই টাকা পাব কি না সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। আমার পাঁচজন শ্রমিক রয়েছেন, তারা কীভাবে চলবেন। আমার আয় না থাকলে আমি তো তাদের টাকা দিতে পারব না।’

তিনি জানান, ‘বড় বড় ট্যানারি মালিক ও শ্রমিক নেতাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। ৩ এপ্রিল মালিক ও শ্রমিকদের উপস্থিতিতে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠক থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে বলে আমরা জেনেছি।’

হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে গিয়ে ব্যবসা করতে সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ পেলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। এখানে যেমন ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। ওখানেও কারখানা মালিকদের কাছ থেকে কিছু অংশ ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতে পারব।’

শহীদ ট্যানারির শ্রমিক মো. সুমন বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ৩ এপ্রিল মালিক-শ্রমিক বৈঠক করে শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমরা আবরোধের ডাক দেব। হাজারীবাগ, জিগাতলার সব রাস্তা বন্ধ করে দেব। দেখেছেন তো জিগাতলার রাস্তা একবার বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশ করেছি। আমাদের পেটে লাথি দেয়া হলে আমরা বসে থাকব না।এ সময় পাশে থাকা ক্রিসেন্ট ট্যানারি, গ্রেইট ইস্টার্ন ট্যানারি ও বেঙ্গল লেদারের ছয়জন শ্রমিক শহীদের কথায় সায় দিয়ে বলেন, তারা আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তাদের সঙ্গে শাহীন আহমেদ, রশিদ ভূঁইয়াসহ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা রাস্তায় থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন। বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলনের সব পরিকল্পনা ঠিক করা হবে।

এ বিষয়ে সোমবার বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ মোবাইল ফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে ট্যানারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা ব্যবসা করতে না পারলে, উৎপাদন করতে না পারলে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। আর শ্রমিকদের বেতন যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন তারা এমনিই আন্দোলনে নামবেন। আমাদের উসকানি দিতে হবে না।‘

এমএএস/এসআর/জেডএ/জেআইএম