গলিপথেও যেন বিষাদের ছায়া। কোলাহল যেন থমকে গেছে। প্রায় রাতে পাজেরো জিপের শব্দের অপেক্ষায় কান পেতে থাকা কুকুরটিও মুখ লুকিয়েছে বারান্দায়। বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল আওয়ালের চোখজুড়ে নিদারুণ হাহাকার। যেন কাছের কোনো স্বজন হারিয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে মা সায়েদা করিমের চোখের নোনা জল। মায়ের মতোই তার বিদায়কে কেউ মেনে নিতে পারছেন না। আবেগতাড়িত মহল্লাবাসী, গলির মুখে ঝুলিয়ে রাখা শোকাহত ব্যানারই তাদের অভিব্যক্তি।
Advertisement
মিরপুর-২ এর বড়বাগের ঝিলের ওপর রেখে যাওয়া জমিতে ষষ্ঠ তলা বাসা নির্মাণ করেছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। মা ও ভাইকে নিয়ে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি।
গলিপথে ঢুকে সামনে যেতেই মুদি দোকান। লে. কর্নেল আজাদের বাড়ির ঠিকানা জানাতেই আগ্রহ নিয়ে দোকানের বাইরে আসেন মালিক সায়েম। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘অমন ক্ষমতাবান, পদস্থ কর্মকর্তা এ এলাকায় থাকত তা জানতেন না মহল্লার অনেকেই। তবে বাবার সম্মানে যারা চিনতেন তাদের কারও সাধ্য নেই আজাদ ভাইকে খারাপ বলা।’
সায়েম বলেন, ‘অমন মানুষ এ যুগে আর আইবো না। বিপদে পইড়া যেই তার কাছে গেছে হেই সহযোগিতা পাইছে। সহযোগিতা করতে না পারলেও ভালো পরামর্শে বিদায় দিছে। বিভিন্নহানে ফোন কইরা অনেকের কাজ হাসিল করায় দিছে। অল্প সময়ে গোপনেই লোকটা মানসের আপন হইয়া গেছিল। ফেরেশতার মতো লোকটা বোমায় মারা পড়বো এহনো ভাবতে পারি না। গা ছমছম করে।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় গভীর রাতে ফিরতেন তিনি। তাই দেখা হইতো না। কিন্তু ঠিকই খোঁজখবর নিতেন। দেখা হইলেই সালাম দিয়া জড়ায় ধরতেন, আমগো পোলাপানের খবর নিতেন। গেলবার মেয়ের স্কুলের পরীক্ষায় টাকা দিয়া সহযোগিতা করল। মানতে পারছি না, অমন মানুষের চলে যাওয়া… তার জন্য দেশের আপসোস।’
পাশের দোকানদার বাবুলও এগিয়ে আসেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘কী কইবার আছে, হগগলের কাছে আজাদ ভাই ছিলেন পাকপবিত্র মানুষ। খুব একটা মেশার সুযোগ তার ছিল না। কিন্তু উপকারে ঠিকই তিনি হগগলের আগে এগিয়ে আসতেন।’
গলিপথ পেরিয়ে সামনে যেতেই বাম পাশে নতুন রঙ করা বাসা। বাসার সামনে সাদা রঙে লেখা লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, বাড়ির ঠিকানাও। স্টিলের গেটে বড় তালা ঝুলছে। আগন্তুকের খবরে বেরিয়ে আসেন বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল আওয়াল।
তিনি বলেন, ‘বাড়িটা আজ প্রাণহীন। রাত করে কেউ আর ফেরে না। তার সেই চাচা ডাক, সালাম আর শুনি না। কেয়ারটেকার হলেও বাবার মতোই সম্মান করতো আজাদ বাবাজি। এই যে শোয়ার কাঠের বিছানা ও স্ট্যান্ড ফ্যান দেখছেন, তা আজাদ বাবাজি কিনে দিয়েছিল।’
Advertisement
আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘আমার বাড়ি নোয়াখালী। তার (আজাদ) বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবুও শুধু বিশ্বাস করে তার বাসায় কেয়ারটেকারের চাকরি দিয়েছেন।’
জাগো নিউজকে তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ বাসায় এসেছিলেন ২২ মার্চ, বুধবার রাতে। রাত তখন সোয়া ১২টা। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙেছিল। ঘুম ভাঙতেই বলে ফেলি, জেগে আছি। গেটের কাছে আসতেই আজাদ বাবাজি বলেন, চাচা কষ্ট দিলাম, ঘুমিয়ে ছিলে? বললাম না। ভেতরে ঢুকে বলেন, চাচা আপনি ঘুমান, আমি উপরে যাই। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই এতো রাতে বাসায় আসছি।’
র্যাবের পদস্থ কর্মকর্তা হলেও লে. কর্নেল আজাদের চলনে ও কথায় তা বোঝার উপায় ছিল না। ‘ওই রাতে বেরিয়ে যাওয়ার পথে তার গাড়িচালককে দিয়ে আমাকে ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন। যেন দুধ, কলা, আপেল কিনে খাই। আর বলে পাঠান, ফিরতে ক’দিন দেরি হবে, আমি যেন তার মা ও ভাইয়ের খেয়াল রাখি। আর জীবিত ফিরল না আজাদ বাবাজি…’, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আব্দুল আওয়ালের।
কথার ফাঁকে বাসায় ফেরেন লে. কর্নেল আজাদের ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেল। বাসায় গিয়ে কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সায়েদা করিম। বলেন, ‘আল্লাহ যেন আমার রাসেলের (লে. কর্নেল আজাদের ডাক নাম) মতো সৎ ও সুসন্তান সবাইকে দান করেন। বোমাবাজ, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী যেন কারও সন্তান না হয়। বোমার আঘাতে আমার মতো কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’
গত ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকার জঙ্গি আস্তানায় (আতিয়া মহল) পরিচালিত অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’-এ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যান র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। ঘটনাস্থলের ৩০০ গজ দূরে জঙ্গিদের রেখে যাওয়া বোমা বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন তিনি। স্প্লিন্টার তার বাম চোখ ভেদ করে মস্তিষ্কে আঘাত হানে।
তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ২৬ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ২৯ মার্চ দেশে ফেরত এনে পুনরায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৭ জুন ৩৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাসদর, প্রশাসনিক শাখা, জাতিসংঘ মিশন ব্যানব্যাট-৫ (আইভরি কোস্ট), ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন), র্যাব-১২ এর কোম্পানি অধিনায়ক, এবং র্যাব সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (টিএফআই সেল) উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর হতে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।
জেইউ/এমএআর/এমএস