দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাই চলচ্চিত্রে খলনায়কের সংকট চলছে, এমন কথা চিত্রপুরীতে কান পাতলেই শোনা যায়। অভিনেতা মিজু আহমেদের মৃত্যুর পর এই কথাটি ঘুরেফিরে আজকাল বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে। এর কারণ চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী যুগের পর্দা কাঁপানো খলনায়কদের অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন, আবারও কেউ চলচ্চিত্র থেকে দূরে রয়েছেন। আর নতুন যারা কাজ করছেন তারা অধিকাংশই জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
Advertisement
নামি খলনায়কদের মধ্যে খলিল, রাজীব, হুমায়ূন ফরিদী, মিজু আহমেদ, জাম্বু, আদিল মারা গেছেন। আর এটিএম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ, মনোয়ার হোসেন ডিপজলকে আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। কালে ভদ্রে সাদেক বাচ্চু আসলেও ছবির গল্প ও চরিত্রের দুর্বলতা থাকছেন আলোচনার বাইরে। আর এককালের জনপ্রিয় খল অভিনেতা ডন আগের মত আর সরব নন।
এইসব জাদরেল অভিনেতাদের পরের প্রজন্মের ভিলেন হিসেবে মিশা সওদাগরই একমাত্র ভরসা ইন্ডাস্ট্রির। তিনিই ভিলেন হয়ে পর্দায় হাজির হচ্ছেন কখনো কালো চুলে, কখনো সাদা চুলে। গ্রামে, শহরে, নগরে, বন্দরে যেখানেই চলচ্চিত্রের মন্দ মানুষ প্রয়োজন সেখানেই দেখা মিলে প্রায় নয় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করা শক্তিমান এই অভিনেতার।
তবে এতে করে বৈচিত্রতা হারাচ্ছে চলচ্চিত্রের ভিলেন চরিত্রগুলোর। কমছে নতুনদের সুযোগ। আবার এই কথাও সত্যি, প্রচারণার এই যুগে সবাই নায়ক হতে চান। কেউ কোনো ভিলেনকে আদর্শ মেনে চলচ্চিত্রে আসতে চান না। মিশা পরবর্তী উল্লেখ করার মতো যে ক’জন ভিলেন এসছেন কেউই নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না।
Advertisement
তরুণ প্রজন্মের গুটিকয়েক খল-অভিনেতা দু-একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হলেও শক্ত করে নিজের আসনটি ধরে রাখতে পারছেন না। নতুনদের তালিকায় আছেন শিবা শানু, শিমুল খান, ডিজে সোহেল, টাইগার রবি, জিয়া ভিমরুল।
চলচ্চিত্রে বরাবরই খলনায়কদের ভূমিকা অপরিসীম। তারাই গল্পকে শ্বাসরুদ্ধকরভাবে এগিয়ে নিয়ে গতি এনে দেন। সব মিলিয়ে দর্শক গ্রহণযোগ্য ছবি তৈরিতে খলনায়করাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এককালে রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ূন ফরিদীদের দেখার জন্যই হলে গিয়েছে মানুষ। তাদের মৃত্যুতে উল্লাস করে হাততালি দিয়েছে। তাদের পরবর্তীতে ডিপজল-মিশা একটা ক্রেজ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তারপর থেকে বলা চলে অনেকটাই ম্রিয়মান ভিলেনদের উপস্থিতি।
কেন নতুন করে কেউ জ্বলে উঠতে পারছেন না? জবাবে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, অভিনয়ের প্রয়োজনে ভিলেনদের চলচ্চিত্রের পর্দায় বিচিত্র রূপ ধারণের পাশাপাশি কঠিন কঠিন কাজ করতে হয়। তাই খলচরিত্রে অভিনয় করতে হলে দক্ষ অভিনয়শিল্পী হওয়া আবশ্যক। কেননা, এককালে যারা খল চরিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্দান্ত অভিনেতা। গোলাম মুস্তাফা, রাজীব, খলিল, আহমেদ শরীফ, এটিএম শামসুজ্জামান, সাদেক বাচ্চুরা এই দেশের চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। অভিনয় দিয়ে তারা সমৃদ্ধ করে গেছেন অভিনয়ের আঙিনাকে। সেই মাপের অভিনেতা এখন কই?
তাদের আরও দাবি, আজকাল অভিনয়ের প্রতি গুরুত্বই দেয়া হয় না। সবাই আলোচনায় থাকতে পছন্দ করে। সেবাই নায়ক-নায়িকা হতে চায়। ভিলেন হতে আগ্রহ হয় না কারো। আর যারা হতে চান তাদের দক্ষতা, একনিষ্ঠতার অভাব আছে। পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিচালকদেরও অনেক সমস্যা আছে। তারা গল্পই বাছাই করে নায়ক-নায়িকা নির্ভর। ভিলেনের দুটি ঘুষি দেয়া ছাড়া তেমন কোনো অংশগ্রহণ দেখা যায় না। ভিলেনের আসল শক্তি কিন্তু কূটচাল, গল্পের মোড় ঘুরানো। এখন এইসব একদম নেই। বরং বলা যায়, ভিলেনরাই নায়ক-নায়িকার স্বার্থে পর্দা জুড়ে ঘুরে বেড়ায়।
Advertisement
আরও একটা সমস্যা হলো স্বস্তা আলোচনার জন্য অনেক পরিচালক সাবেক-বর্তমান নায়কদেরকেই ভিলেন হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। যার ফলে পেশাদারীত্বেও আঘাত আসছে ভিলেনদের। বাড়ছে হতাশা। আর আজকাল অভিনয়ের বিচার কেউ করে না। সবাই সেরা, সবাই মহাঅভিনেতা। কিন্তু দর্শক নিচ্ছে না কাউকেই।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা আরও একটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সেটি হলো এককালে রিনা খান, নাসরিনের মতো প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় অভিনেত্রীরা খল চরিত্রে অভিনয় করে ক্রেজ তৈরি করেছেন। দর্শক পর্দায় তাদের দেখলেই ভয় পেত এই বুঝি কারও সংসার ভাঙল, কারো হৃদয় ভাঙলো। কিন্ত আজকাল কোনো মেয়ে বা নারীই মন্দ চরিত্রে অভিনয় করতে চান না। যারা করছেন হয় তারা নতুন নয়ত বা প্রযোজক-পরিচালকের আত্মীয়-পরিচিতা। আনকোরা-অদক্ষ অভিনয় দিয়ে তারা বিরক্তি উৎপাদন ব্যাতীত তেমন কিছুই উপহার দিতে পারছেন না।
আপাতত বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাতারা একমাত্র খলনায়ক মিশা সওদাগরের ওপর নির্ভর করে আছেন। একমাত্র তিনিই দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। ১৯৯০ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদের ‘চেতনা`’ শীর্ষক চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে প্রথমে অভিনয় করেন। ১৯৯৫ সালে ‘আশা আমার ভালোবাসা’ ছবিতে খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। সেই সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে এ পর্যন্ত প্রায় নয় শতাধিক ছবিতে খলনায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন।
মিশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজীব, হুমায়ূন ফরীদি ভাইয়ের সময় আমি নিজেকে অপরিহার্য্য করে তুলেছি। এটা কিন্তু ২০-২৫ বছর আগের কথা। তখনই নির্মাতা ‘মিশাকে লাগবে’ এই প্রয়োজনটা অনুভব করেন। কিন্তু এখন যারা কাজ করছেন তারা সেটা পারেনি। এর কারণ একাধিক হতে পারে। তাদের অভিনয় দুর্বল হতে পারে, হতে পারে তারা মন দিয়ে কাজ করে না। আবার তারা সঠিক চরিত্র পাচ্ছেন না এমনটাও হতে পারে।’
নবীন খল অভিনেতা শিমুল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যারা নবীন তাদের খল অভিনেতার কাজটি নিয়ে একদমই চর্চা নেই। তারা কেউ নিজেদের অভিনয় নিয়ে গবেষনা করছেন না। হুজুগে ফিল্মে আসছেন কাজ করতে। এর ফলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমি নিজে আমার প্রতিটি কাজ নিয়ে চর্চা করি। কোনটা ভালো হলো, কোনটা খারাপ হলো এটা নিয়ে বিশ্লেষণ করি। শুনেছি আগামীতে নতুন মুখ নেয়া হচ্ছে। আমি বলবো শুধু নতুন মুখ নিলেই হবে না, নতুন মুখ যারা আসবে তাদের মধ্যে ভালো কাজ করার চর্চাটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাদের জন্য ভালো চরিত্রও তৈরি করতে হবে সিনেমায়।’
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহা সচিব বলিউল আলম খোকন বলছেন, ‘সবাই চলচ্চিত্রে এসে নায়ক-নায়িকা হতে চাচ্ছেন। কেউ খলনায়ক বা খলনায়িকা হতে চান না। কিন্তু তারা যদি এ চরিত্রে এসে ভালো অভিনয় করেন, তাহলে দর্শক তাদেরও চিনবে। তাদের নামের ওপর ভিত্তি করে দর্শকরা হলে গিয়ে ছবি দেখবে। নতুন যারা আসবে, তারা তো একদিনে এসে এ জায়গা দখল করতে পারবে না। সময় নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। তাহলেই কেবল তারা নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।’
এদিকে চলচ্চিত্র খল নায়ক সংকট নিয়ে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে খল-অভিনেতার যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা দূর করতে তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অভিনয়টাকে মূখ্য করেই তাদের খল-অভিনেতা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, একটি চলচ্চিত্রে খল-অভিনেতার গুরুত্ব সব থেকে বেশি। কারণ, তাদের ছাড়া চলচ্চিত্র প্রাণ পায় না। এনই/এলএ