মতামত

গো হিলারি গো

দুই দিন আগে গিয়েছিলাম মেয়েদের এক কনফারেন্সে। কনফারেন্সের আয়োজন করেছে প্রফেশনাল বিজনেস ওমেন অফ ক্যালিফোর্নিয়া। সুযোগ পেলেই আমি প্রায় প্রতি বছরই যাই এই কনফারেন্সে। পুরো বছরের টনিকের মতো কাজ করে। তবে এবছরের সাথে অন্য কোনো বছরেরই কোনো তুলনা হয় না।

Advertisement

এমন সব বাঘা বাঘা বক্তা, তাঁদের বক্তব্য, তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের প্রাণশক্তি আমাকে এমনই এক আবেশে আবিষ্ট করে ফেলেছিল যে পুরো দুদিনেও সেই আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমার প্রাণের মাঝে কূল কূল করে বয়ে যাচ্ছে সেই সঞ্জীবনী সুধা। এই সব বক্তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য। আমেরিকার শক্তিশালী দুটো রাজনৈতিক দলের একটি থেকে বিজয়ী প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সেক্রেটারি ক্লিনটন।

আমি খুব যে রাজনীতির সাথে জড়িত তা নয়। টিভির পর্দায় হিলারিকে দেখেছি, কথা শুনেছি ঝানু রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সেক্রেটারি ক্লিনটনের। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে আমার কেমন লেগেছে, তাঁর কথায় কতটা মুগ্ধ হয়েছি সেই আলোচনায় যাব না, তবে একজন শক্তিশালী নারী হিসেবে, নারীদের জন্য একজন রোল মডেল হিসেবে তাকে দেখে আমি অভিভূত, তাঁর কথা গুলো গভীরভাবে আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেছে। হল ভর্তি সাড়ে পাঁচ হাজার উচ্চ শিক্ষিত মহিলা সেদিন মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

হিলারির মা মাত্র ১৪ বছর বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করে। সে বাড়ির গৃহকত্রী তাঁর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁকে বলেন সে স্কুলের আগে সকালে আর পরে বিকেলে এসে কাজ করে দিলেও হবে। এ যেন ছিল তাঁর জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ। ১৪ বছরের এই মেয়েটির ছিল একটি মাত্র স্কার্ট আর দুটো শার্ট। দয়ালু সেই গৃহকত্রীর নজরে সেটাও এড়ায় নি। নিজের কিছু পুরনো কাপড় দিয়ে দেন তাঁকে। এমন একটি মায়ের আদর্শে বড় হয়েছেন হিলারি।

Advertisement

কম বয়সে এক বার শখ হয়েছিল নভোচারী হওয়ার, তাকে জানানো হয় মেয়েদের জন্য এই সুযোগ নেই। সেই প্রথম খটকা লাগে তাঁর, তবে কী মেয়েদের ছেলেদের মতো একই সুযোগ নেই? পরবর্তীতে হার্ভার্ড ল স্কুলে সুযোগ পাওয়ার পর একই বিভাগের এক শিক্ষক মেয়েদের ল পড়া নিয়ে কটাক্ষ করলে সেটাও তাঁকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তারপর আর কিছুই তাঁকে মেয়ে বলে আটকাতে পারে নি। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে অন্যতম সফল মহিলা বললে তাঁকে কম বলা হয়। নারী এবং শিশুদের জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

আমাকে যেটা সব চেয়ে মুগ্ধ করেছে সেটা তাঁর উঠে দাঁড়ানো, তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। আমেরিকা যতই উন্নত হোক, আজ পর্যন্ত এখানে কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট হয় নি, এমনকি রাজনৈতিক দল দুটো থেকে মহিলা প্রার্থীও আসেনি। এই প্রথম একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করলো, এটাও বিশাল ব্যাপার। ৬৯ বছরের বৃদ্ধা নিঃসন্দেহে তাঁর সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করেছেন। অল্পের জন্য আশাতীত ভাবে তিনি হেরে গেছেন।

আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী তিনি আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তাঁর জীবনের হয়তো সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ স্বপ্ন ছিল এটা। সেটা ভেঙে যাওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড ভাবে ভেঙে পড়বেন, লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যাবেন, নিজেকে গুটিয়ে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি সাধারণ, স্বাভাবিক এগুলোর ঊর্ধ্বে। তাই ফিরে এসেছেন দ্বিগুণ শক্তিতে। কারণ দেশকে, দেশের মেয়েদেরকে তিনি পিছিয়ে দিতে দেবেন না কিছুতেই।

আমেরিকান বর্তমান প্রেসিডেন্টের নারীদের প্রতি মনোভাব নিয়ে, তাঁর নারী সম্পর্কিত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তাই অনেকেই আশঙ্কায় আছে। হিলারির ভাষ্যমতে `সবাই যেখানে অন্ধকার দেখছে, আমি দেখছি আলো, কারণ এই সব পশ্চাৎপদ পদক্ষেপকে ঠেকাতে আলো জ্বালাতেই হবে আমাদেরকে, তাই আমি আশাবাদী।` কতোখানি মানসিক শক্তি থাকলে একজন ভেঙে পড়া মহিলা, হেরে যাওয়া মহিলা আর সব মেয়েকে এভাবে আশার আলো দেখাতে পারে সেটা আসলেই বিরল।

Advertisement

তিনি বলছিলেন ` মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে বিল হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করছে ছেলেরা। এটা কেমন কথা? মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই সবচেয়ে ভালো বোঝে।` এই কথাটা খুব মনে ধরেছে আমার। `মেয়েরা কীভাবে চলবে, কী পোশাক পরবে, হিজাব পরবে না হাফ প্যান্ট পরবে` এসব নিয়ে আমি অনেক সময়ই অনেক ছেলেকে তর্ক বিতর্ক করতে দেখি, অবাক করা কাণ্ড হলো মাঝে মাঝে কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মেয়েদেরেকেও দেখি ছেলেদেরকে এসব আলোচনায় উস্কে দিতে।

জানি পিছিয়ে থাকা নারীদেরকে এগিয়ে যেতে অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের সাহায্য লাগবে, কিন্তু `মেয়েদের স্বাস্থ্য সমস্যা বা পোশাকের` মতো একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা সিদ্ধান্তে ছেলেদের উপর নির্ভরতা এক ধরনের দুর্বলতার নামান্তর। হিলারি যথার্থই প্রমাণ করলেন তিনি একজন সবল নারী, এবং পৃথিবীর সকল নারীর শক্তিতে তিনি বিশ্বাসী। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে যেসব মেয়ে, তাঁদের জন্য তাঁর এই বিশ্বাসটুকু অমূল্য। এগিয়ে যাক হিলারি, এগিয়ে নিয়ে যাক আমেরিকা এবং গোটা পৃথিবীর নারীদেরকে।

লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।

এইচআর/পিআর