ইতিহাস জানাচ্ছে ২০০৬ সালের মার্চে পাকিস্তানের সাথে তিন ম্যাচের সিরিজে ২-০তে (বৃষ্টিতে প্রথম ম্যাচ পণ্ড হয়েছিল) হারা ছাড়া গত ১১ বছরে ঘরের মাঠে কোনো ওয়ানডে সিরিজে জয়শূন্য ছিল না শ্রীলঙ্কা।
Advertisement
সিরিজ হারলেও অন্তত একটি ম্যাচ ঠিকই জিতেছে। সেই শ্রীলঙ্কা এবার বাংলাদেশের সাথেও ২০০৬ সালের পরিণতির খুব কাছাকাছি। বাংলাদেশের ভক্ত ও সমর্থকরা যতটা উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ক্রিকেটারদের বিজয় দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, লঙ্কানরাও তেমনি উন্মুখ হয়ে ছিল সম্মান রক্ষায়।
তাই তো আজ সকালে খেলা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে পিচ দেখতে মাঠে চলে আসলেন দুই লঙ্কান নির্বাচক জয়সুরিয়া ও কালুভিথারানা। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ওয়ার্মআপের পর হাল্কা স্ট্রেচিং করছে দুই দল।
এমন সময় মাঠে ঢুকলেন সনৎ জয়সুরিয়া। সাথে রমেশ কালুভিথারানা। শ্রীলঙ্কার প্রথম বিশ্বকাপ বিজয়ী দলের দুই ওপেনার এখন লঙ্কান নির্বাচকও। প্রধান নির্বাচক জয়সুরিয়া একদম দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা পিচের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে উইকেট বোঝার চেষ্টা করলেন।
Advertisement
তারপর সহযোদ্ধা কালুভিথারানাকে সাথে নিয়ে কিওরেটরের সাথেও খানিক্ষণ কথা বললেন। কি আলাপ হলো তাদের মাঝে? প্রেস বক্স থেকে তা বোঝা না গেলেও উইকেটের চরিত্র ও আচরণ নিয়েই যে কথা হলো সেটা বলাই যায়। চোখে দেখে এবং কিওরেটরের সাথে কথা বলে পিচ সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা নিয়েই ড্রেসিং রুমে গেলেন এই দুজন। এরপর কোচ ও অধিনায়কের সাথে বসে একাদশ ঠিক করলেন লঙ্কান দুই নির্বাচক।
বাংলাদেশ শিবিরও উইকেট সম্পর্কে প্রতিদিনের মত ধারণা নিল। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, ব্যাটিং কোচ সামারাবিরা আর অধিনায়ক মাশরাফি উইকেট দেখেই একাদশ অপরিবর্তিত রাখলেন; কিন্তু একটা জায়গায় ভুল করে ফেললেন, উইকেট শতভাগ ব্যাটিং সহায়ক হওয়ার পরও টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নিলেন অধিনায়ক মাশরাফি।
দিন শেষে প্রমাণ হলো, সেটাই ছিল মারাত্মক ভুল। কখনো কখনো পারফরম্যান্সকে নিয়ন্ত্রণ করে টিম ম্যানেজমেন্টের কিছু সিদ্ধান্ত। আজকের ম্যাচে বাংলাদেশের করুণ পরিণতির পিছনে ক্রিকেটারদের বাজে পারফরম্যান্স যতটা দায়ী, টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্তটা তার চেয়ে অনেক বড় দায়ী।
হয়তো তারা প্রথম ম্যাচ দেখে লঙ্কান ব্যাটিংকে খানিক নড়বড়ে ভেবেছিলেন; কিন্তু উপুল থারাঙ্গার দল আসলে কি তত অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ? তাই যদি হতো তাহলে আর পরের ম্যাচে ৩১১ এবং আজ তুলনামুলক স্পোর্টিং ও সময়ের সাথে সাথে স্লো হয়ে যাওয়া পিচে ২৮০ রানের বড় স্কোর গড়তে পারত না তারা।
Advertisement
এখন বোঝা যায়, ডাম্বুলার রণগিরি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ৩২৪ রানের বড় স্কোর গড়ায় মানসিক চাপে পড়ে যায় লঙ্কানরা। সে চাপ কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে ব্যাটিংটাকে খানিক দূর্বল মনে হচ্ছিল।
প্রশ্ন উঠেছে, জেনেশুনে লঙ্কানদের আগে ব্যাট করতে দেয়া কেন? এই মাঠে নয় তাতে কী? এই দলটিই তিনদিন আগে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা বড়-সড় স্কোরের পিছু ধেয়ে না পারলেও আগে ব্যাট করতে পারলে ৩০০‘র ওপরে (৩১১) রান করতে পারি।
থারাঙ্গা, কুশল মেন্ডিস, চান্দিমাল, গুনারত্নে আর থিসারা পেরেরার সামনে বড় সড় স্কোরের চাপ নিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে না পারলেও আগে চাপমুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশের বোলিংকে স্বচ্ছন্দে খেলে বড় স্কোর গড়তে পারেন, তা পরীক্ষিত।
তা দেখেও আবার লঙ্কানদের আগে ব্যাট করতে দেয়ার পেছুনে কী যুক্তি থাকতে পারে? এ প্রশ্ন দেখা দিল টস জিতে মাশরাফি বিন মর্তুজার আগে ফিল্ডিং নেয়ার পর থেকেই। প্রথম উইকেটে উপুল থারাঙ্গা আর গুনাথিলাকার সাবলীল ও ফ্রি স্ট্রোক প্লে দেখে সে পক্ষের অনুসারী আরও বেড়েছে।
৫০ ওভার শেষে শ্রীলঙ্কার রান ২৮০ স্পর্শ করায় সে প্রশ্ন আরও জেরালো হলো। মানা গেল দল সাহস ও আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। প্রস্তুতি ম্যাচে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি একাদশের বিরুদ্ধে ৩৫৪ রানের হিমালয় সমান স্কোর তাড়া করে সাড়ে তিনশ’র ঘরে (৩৫২) পৌঁছে যাওয়াটা হয়তো অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে আছে।
ভিতরে নিশ্চয়ই বিশ্বাস জন্মেছে, টার্গেট যত বড় আর কঠিনই হোক- আমরা পারবো। তামিম-সাকিবকে ছাড়াই প্রস্তুতি ম্যাচে সাড়ে তিনশ করে ফেলেছি, ওদেরসহ তিনশ’র কাছাকাছি রান টপকাতে পারব না?
এই বিশ্বাস, বোধ ও আস্থাকে এতটুকু খাটো না করেই বলে দেয়া যায়, এই গরমে ৫০ ওভার পুরো ফিল্ডিং করার পর বড় রান তাড়া কী একটু হলেও বাড়তি ঝক্কি নয়? তবে কী সিদ্ধান্তটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা?
অধিনায়ক মাশরাফি কাল প্রেস কনফারেন্সে বার কয়েক বলেছেন, লঙ্কানরা যাতে কিছুতেই ৩০০ করতে না পারে সেটাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। তবে কী আগে থেকেই ঠিক করে রাখা, আমরা ফিল্ডিং করব আগে এবং লঙ্কানদের ২৭০-২৮০’র মধ্যে আটকে রেখে ওই রান তাড়া করে জিতব?
গেম প্ল্যান এমন থাকলে বোলিংটা আরও গোছানো হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তা আর হলো কই? বোঝাই গেল উইকেটের গতি ও প্রকৃতি বুঝতে আর তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিতেই শেষ হয়ে গেল ম্যাচ।
প্রথমে বোলাররা হাঁটলেন ভুল পথে। তারা ভেবেছিলেন এটা বোধ হয় ৩০০ রানের উইকেট। আমরা ২৮০‘তে বেধে ফেলে বরং ভালোই করেছি। আর তার পরের ভুলটা হলো ব্যাটসম্যানদের। উইকেট স্লো হয়ে গেছে। এখানে গিয়েই তেড়ে ফুড়ে মারা যাবে না। ইচ্ছেমত ফ্রি স্ট্রোক খেলাও খুব কঠিন।
দেখে বলের মেধা ও গুণাগুন বিচার করে আগে উইকেটে সেট হতে হবে। সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে তারপর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে-বোঝাই গেল তামিম, সাব্বির, মুশফিক ও মোসাদ্দেকদের মাঝে ছিল না।
তারাও ভুলের মাশুল দিলেন। ১১ রানে তিন উইকেট খোয়ানোর পর সৌম্য ও সাকিব চেষ্টা করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে উইকেটে থেকে শুরুর ক্ষত মুছে ইনিংসকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করলেন ওই দুই বাঁ-হাতি; কিন্তু তাদের চেষ্টাও যথেষ্ঠ ছিল না।
এক সময় গিয়ে ঠিকই সাজঘরে ফেরত আসা। যে ম্যাচটি হতে পারতো সোনালী সাফল্যে মোড়ানো। সে ম্যাচ হয়ে গেল ‘ভুলের প্রতীক।’
ভুলে ভুলে হাতছাড়া হলো ইতিহাস গড়ার সুবর্ণ সুযোগ। কে জানে এমন ইতিহাস গড়ার সুযোগ আবার কবে আসবে?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম