গত কয়েক মাস ধরে বেড়েই চলেছে চালের দাম। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম আবারও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
Advertisement
মৌসুম শেষ হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। লাগামহীনভাবে চালের দাম বাড়ানোয় বেকায়দায় আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। গেল মাসেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছিল। এ মাসেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের দোকানগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে একই মানের চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায়। এ হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপণ্যটির দাম কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে।
বাজারে মোটা চালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে মিনিকেটও। গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৪ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এর দাম কেজিপ্রতি ৪৮-৫২ টাকা ছিল। সপ্তাহের ব্যবধানে এটি কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে।
Advertisement
চালের দাম বাড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেও। সংস্থাটির হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৭-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর একই চাল কেজিপ্রতি ৩২-৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বাতামতলী চাল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, মোটা চালের দাম একটু বেশি বেড়েছে। এ চালের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। দাম বাড়ার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, শিগগিরিই বাজারে নতুন চাল আসবে। এখন মৌসুম শেষ তাই কিছুটা সংকট রয়েছে। এর বাইরে ভারত থেকে চাল আমদানি না হওয়ায় দাম একটু বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চৈত্র মাস হওয়ায় চালের মৌসুম শেষ হয়েছে। ফলে চালের সংকট দেখা দিয়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে এর প্রভাব খুচরা বাজারে পড়বেই। সব তাদের হাতে, এখানে আমাদের কোনো কিছুই করার নেই।
বাবুবাজারের রশিদ রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মনির হোসেন জমাদার বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মোটা চাল মজুদ আছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই পণ্যটির দাম বাড়ার কথা নয়। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর যোগসাজসেই মোটা চালের দাম বাড়ছে।
Advertisement
বাজারে পারিজাত চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়, গত সপ্তাহে ছিল ৪০ টাকা; গুটিস্বর্ণা ৪০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৩৮ টাকা; আটাশ চাল ৪৬-৪৭ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৪৪-৪৫ টাকা; নাজিরশাইল ৫২-৫৭ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৫০-৫৫ টাকা কেজিপ্রতি।
চালের দাম বৃদ্ধির এ প্রবণতা মূল্যস্ফীতে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে ছিল। মার্চ মাসে সেটি আরও বাড়তে পারে।
এদিকে, চালের দাম বেড়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও। জাগো নিউজের নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, গত ১৫ দিনে প্রতি কেজি মোটা চাল দুই থেকে তিন টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে এটি আরো বৃদ্ধি পাবে- এমনটি জানিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মূল্য বৃদ্ধির জন্য বড় বড় মিলার ও চাল ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন তারা।
নওগাঁয় মোটা জাতের স্বর্ণা প্রতি কেজি ৩৮ টাকা, পূর্বে ছিল ৩৫ টাকা, প্রতি ৫০ কেজি ওজনে বস্তা এক হাজার ৭৫০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় (পূর্বে ছিল ১৬০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। চিকন স্বর্না প্রতি কেজি ৪০ টাকা, পূর্বে ছিল ৩৭/৩৮ টাকা এবং প্রতি ৫০ কেজি ওজনে বস্তা দুই হাজার টাকায় (পূর্বে ছিল এক হাজার ৯০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ গত ১৫ দিনে প্রতি কেজি চাল দুই থেকে তিন টাকা এবং বস্তাপ্রতি প্রায় ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে চিকন চালের দাম গত কয়েক মাসে বাড়েনি।
বদলগাছীর ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ী মিলন হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে দেড়শ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটা জাতের ধানের দাম ৯৫০ থেকে হাজার টাকা মণ। বাজারের ধানের আমদানিও কম। কৃষকদের ঘরে ধান নেই। হাট-বাজারে যেটুকু ধান আসছে বেশি দাম দিয়ে তা কিনতে হচ্ছে।
নওগাঁর পৌর ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার বলেন, আগামীতে চালের দাম আরো বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় বড় বড় ব্যবসায়ী ও মিলাররা চাল মজুদ করে রাখায় চালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নওগাঁর আড়তদার ফরিদ অ্যান্ড সুলতান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শেখ ফরিদ উদ্দীন বলেন, চালের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার এটা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে জনগণকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এখন হাট-বাজারে ধানের আমদানি নেই। কৃষকের ঘরেও ধান নেই। এখন যে ধান থেকে চাল তৈরি হচ্ছে তা আগের মজুদ করা।
জরুরি ভিত্তিতে ডিউটি কমিয়ে ভারতে থেকে চাল আমদানি শুরু করলে চালের বাজার কমে আসবে বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি আলহাজ রফিকুল ইসলাম রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
রাজশাহীর বাজারেও বেড়েছে চালের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চাল ভেদে কেজিতে বেড়েছে এক থেকে দুই টাকা। আর পাইকারি বাজারে বস্তায় বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। দাম বাড়ার বিষয় স্বীকার করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহীল কয়েকজন চালকল মালিক বলেন, মৌসুমের শুরুতে তারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ধান কেনেন। চালকল চালু রাখতেই তারা মজুদ করেন। ব্যাংক ঋণের সুদ, শ্রমিক ও পরিবহণ খরচ ধরে চালের দাম নির্ধারণ করেন তারা। সবমিলিয়ে তাদের লাভের পরিমাণ সীমিত থাকে।
বৃহস্পতিবার নগরীর অন্যতম পাইকারি চালের বাজার কুমারপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ টাকায়। একই পরিমাণ আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্তা (৮৪ কেজি) গুটি স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৯০০ টাকায়। একই পরিমাণ চিকন স্বর্ণার দাম তিন হাজার ১৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে কেবল এ চার ধরনের চালের আধিক্য রয়েছে। এক সপ্তাহ আগে রকম ভেদে এসব চাল বিক্রে হয়েছে বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে।
পাইকারি চালবিক্রেতা আহমেদ রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক আব্দুর রশিদ বলেন, তারা চালকল মালিকদের সরবরাহ করা চাল কমিশনে বিক্রে করেন। রাজশাহী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হয় চাল। মূলত চালের দাম নির্ধারণ করে দেন মিল মালিকরা। এখন চালের বাজার চড়া। মিল মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বাড়তি থাকায় বাড়ছে চালের দাম। তবে মাসখানিক পর কৃষকের গোলায় উঠবে বোরো ধান। তখন কমে যাবে চালের দাম।
আব্বাস আলী/এমএ/এমএআর/এমএস