বিশেষ প্রতিবেদন

বাম্পার ফলনের আশা, এরপরও আতঙ্কে আমচাষিরা

অনুকূল আবহাওয়ার কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন চাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা। তবে অপরিপক্ব আম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকিয়ে বাজারজাত করা বন্ধে গত কয়েক বছর গাছ থেকে আম পাড়ার একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হচ্ছে। ফলে সময়ের আগে আম পাকলেও চাষিরা বাজারজাত করতে পারছেন না। সময় বেঁধে দেয়ায় একসঙ্গে বাজারে আমের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে এবারও আতঙ্কে রয়েছেন জেলার আম চাষিরা।

Advertisement

সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে মুকুল থেকে গুটি আসতে শুরু করেছে। ভালো ফলন পাওয়ার আশায় মুকুল থেকেই উন্নত পদ্ধতিতে পরিচর্যা শুরু করছেন চাষিরা। আম ছিদ্রকারী পোকাসহ অন্য কোনো ক্ষতিকারক পোকা যাতে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য কীটনাশক ব্যবহার করছেন তারা। এ বছর গাছে যেভাবে মুকুল এসেছে, শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে শতভাগ ফলন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে এবারও অপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ে আম পাড়ার সময় বেঁধে দিলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে মনে করছেন আমচাষি, বাগান মালিক ও কৃষি কর্মকর্তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাবেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং ইউএসআইডির প্রকল্পে কর্মরত সাদিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আবহাওয়াগত কারণে আম পরিপক্ব হয়। আম পাকার সময়ের মধ্যে তারতম্য অবশ্যই হবে। যে বছর আবহাওয়া শুষ্ক থাকে সে বছর আম নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পেকে যায়। আবার যে বছর আমের মৌসুমে বৃষ্টি হয় এবং আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে সে বছর আম দেরিতে পাকে। আবার যে বাগানে বা আম গাছের যে পাশে সূর্যের তাপ বেশি লাগে সে পাশের আম দ্রুত পেকে যায়। ফলে আম পাকার একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া যুক্তিহীন, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হতে পারে না।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর যেকোনো ধরনের আম পাড়ার সময় ২৫ মে নির্ধারণ করা হয়। ২৫ মে গোপালভোগসহ গুটিজাত; ১ জুন হিমসাগর/ক্ষীরসাপাত, লক্ষণভোগ; ১০ জুন ল্যাংড়া ও বোম্বাই; ২৫ জুন ফজলি; ১ জুলাই আম্রপলি এবং ১৫ জুলাই আশ্বিনা আম বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে নাবি জাতের ফজলিসহ অন্যান্য আম পর্যায়ক্রমে বাজারে আনার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ধারণ না করায় অনেক কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

শিবগঞ্জ উপজেলার রানীহাটি গ্রামের কৃষক হাসান আলী জানান, নির্দিষ্ট সময়ের আগে আম গাছে পেকে গেলেও তারা আম পাড়তে পারেননি। আবার বাজারে একসঙ্গে আমের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা মারাত্মক লোকসানের শিকার হন। একই জাতের আম বিভিন্ন সময়ে পরিপক্বতা আসতে পারে। পাশের বাগান দেখিয়ে তিনি জানান, একই জাতের আম মুকুল অবস্থায় আছে আবার কোনো বাগানে গুটি মাত্র শুরু হয়েছে। কোনো কোনো বাগানে গুটি একটু বড় হয়েছে। আম সারাদেশে কম-বেশি হলেও শুধু কয়েক জেলায় সময় বেঁধে দেয়া অযৌক্তিক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আম পাড়ার সময় বেঁধে দেয়া সঠিক কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই আম পাড়া যায়। ওই আম কিছু ব্যবহার না করেই ৫-১০ দিন ঘরে রাখা যায়। আম পাড়ার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ এ অঞ্চলে একই জাতের আম বিভিন্ন সময়ে পরিপক্ব হতে দেখা যায়। কেউ ক্ষতিকর কিছু ব্যবহার করলে তাকে সচেতন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক তদারকির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়।

ড. শরফ উদ্দিন আরো বলেন, গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম পাড়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। এরপরও যদি কোনো কৃষকের আম সময়ের আগেই পেকে যায় তাহলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অনুমনি নিয়ে তা পাড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা অনেকেই জানতেন না। না জানায় তারা সে সুবিধা নিতে পারেননি।

Advertisement

আম পাড়ার সময় বেঁধে দেয়ার আতঙ্কের মধ্যেও চাষিদের সুখবর দিচ্ছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মনজুরুল হুদা। তিনি বলেন, চলতি বছর জেলার পাঁচ উপজেলায় ২৬ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৫০ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া রোগবালাইয়ের সংক্রমণ তেমন না থাকায় বাম্পার ফলন আশা করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, শুধু ভালো ফলনই নয়, এবার আমের ফলন বিগত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

আম পাড়ার সময় নির্ধারণ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, এবার সময় নির্ধারণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দুটি বৈজ্ঞানিক সভা করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। একই জাতের আম বিভিন্ন সময়ে পাকলেও একটি নিরাপদ সময় নির্ধারণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, সময় নির্ধারণের পরও যদি কারও আম আগে পেকে যায় তাহলে আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখব।

আম পাড়া নিয়ে কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত রাখা হবে। ইতোমধ্যে জেলা শহরের বিভিন্ন ইউনিয়নে এ বিষয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে।

এমইউএইচ/এমএআর/এমএস