দেশজুড়ে

সংগ্রহের সময় নির্ধারণ নিয়ে আতঙ্কে আম চাষিরা

বরাবরই কিছু ব্যবসায়ী আগেভাগেই বাজারে তোলেন আম। অপরিপক্ক আম ক্ষতিকর রাসায়নিকে পাকিয়ে বাজারে তোলেন তারা। তবে কয়েক বছর ধরেই এ প্রক্রিয়া ঠেকাতে আম বাজারজাতের সময় বেঁধে দিচ্ছে সরকার।

Advertisement

কিন্তু সরকারি এ সিদ্ধান্তে আগে পাকা আম বাজারজাত করতে না পারায় কয়েক বছর ধরেই বিপাকে এই অঞ্চলের হাজারও আম চাষি-ব্যবসায়ী। পাচ্ছেন না আমের ন্যায্য দামও। আসছে আমের মৌসুম ঘিরেও একই আতঙ্ক ভর করছে তাদের মনে। এরই মধ্যে মুকুল থেকে গুঁটিতে রূপ নিয়েছে এই অঞ্চলের বাগানজুড়ে আম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক আম চাষ হয় এমন জেলাগুলোয় গত বছর ২৫ মের পর আম সংগ্রহের সময় বেঁধে দেয় সরকার। বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী ২৫ মে গোপালভোগসহ গুঁটিজাত, ১ জুন হিমসাগর-ক্ষীরসাপাত, লক্ষ্মণভোগ, ১০ জুন ল্যাংড়া ও বোম্বাই, ২৫ জুন ফজলি, ১ জুলাই আম্রপলি ও ১৫ জুলাই আশ্বিনা আম বাজারজাতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পরবর্তীতে নাবি জাতের ফজলিসহ অন্যান্য আম পর্যায়ক্রমে বাজারে আনার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সময় বেঁধে দেয়ার এ সিদ্ধান্তে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন অনেক কৃষক।

Advertisement

আম বাজারজাতের সময় বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা।

কয়েকজন চাষি বলেন, সময় বাঁধা থাকায় পাকা আমও তারা বাজারে তুলতে পারেননি। আবার আম যখন বাজারে ওঠে তখন অনেক আম ওঠে যায়। এতে নায্য দাম মেলে না। কয়েক বছর ধরে এতে চাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একই আম বিভিন্ন সময় পাকে বলেও জানান চাষিরা।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য মতে, মে মাসের মাঝামাঝিতে রাজশাহীর বাজারে উঠে গুঁটি জাতের আম। তবে মে মাসের শেষ ও জুনের শুরু দিকে বাজারে আসেবে গোপালভোগ ও রানীপছন্দ জাতের আম। এর প্রায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাকবে লখনা, ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, দুধসর, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আম।

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আসবে মৌসুমের আকর্ষণীয় ফল ফজলি। এর প্রায় ১৫ দিন পর সব শেষে বাজারে আসবে আশ্বিনা আম। পুরো মৌসুম জুড়ে বাজারে থাকে কয়েকশ জাতের আম। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে রাজশাহীতে। কোটি টাকার বাণিজ্য হয় পুরো মৌসুমজুড়ে। আমেই নির্ধারণ করে এ অঞ্চলের অর্থনীতি গতি।

Advertisement

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিত কর্মকর্তা আলীম উদ্দিন জানান, আম কোনো রাসায়নিক ছাড়াই ৫ থেকে ১০ দিন ঘরে রাখা যায়। আম সংগ্রহে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ এ অঞ্চলে একই জাতের আম বিভিন্ন সময়ে পরিপক্ব হতে দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া ও মাটির গুণগত কারণে এটি হয়। এছাড়া টানা খরা ও অত্যাধিক গরমেরও আম আগেভাগেই পেকে যায়।

জানা গেছে, এবারও আম সংগ্রহে সময় নির্ধারণ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন। যদিও এ অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনদের আপত্তির মুখে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, এবার আম সংগ্রহের সময় নির্ধারণ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দুটি সভা করা হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। একই জাতের আম বিভিন্ন সময়ে পাকলেও একটি নিরাপদ সময় নির্ধারণ করা হবে।

সময় নির্ধারণ করা হলেও পরিপক্ব আম সংগ্রহের বিষয়ে শিথিলতা রাখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আম সংগ্রহ নিয়ে কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত রাখা হবে। এরই মধ্যে জেলা শহরের বিভিন্ন ইউনিয়নে এ বিষয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় সভা করা হয়েছে।

তবে এ নিয়ে এখনো রাজশাহীতে কোন সভা হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দিন। তিনি বলেন, গত বছর সময় বেঁধে দেয়ায় আম চাষি-ব্যবসয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন খবর তাদের কাছে নেই।

বরং চাষি-ব্যবসায়ীরা তাতে উপকৃত হয়েছেন। চাষি-ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে গত বছর। এবছরও একই পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে এখনো রাজশাহী এ সংক্রান্ত কোনো সভা হয়নি।

তিনি বলেন, বিষমুক্ত আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহনে এ উদ্যোগ। বরাবরই কারবাইড, ফরমালিন ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক আমদানির ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া ব্যাগিংয়ের জন্য ব্যাগের দাম কমানো ও পর্যাপ্ত ব্যাগ সরবরাহেরও দাবি থাকে। এসব বিষয়ে গত বছরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তারা।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দফতরের হিসেবে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে গত পাঁচ বছরে আমবাগান বেড়েছে ১৬ হাজার ৫০৭ হেক্টর। সব চেয়ে আমবাগান বেড়েছে রাজশাহীতে ৭ হাজার ৯৭৫ হেক্টর।

এরপর নওগাঁয় ৪ হাজার ৮৬৯ হেক্টর, নাটোরে ২ হাজার ৪৭৩ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক হাজার ১৯০ হেক্টর। শুধু চাষই নয় এ কবছর উৎপাদনও বেড়েছে, ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন।

গত ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছর এ অঞ্চলের ৫৮ হাজার ৯২৪ হেক্টর আম বাগানে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৮ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে।

এবছরও আগান কিছুটা বেড়েছে। ফলে উৎপাদনও বাড়বে বলে ধরে নিচ্ছে কৃষি অধিদফতর। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গত বছর ২৩ হাজার ৪০০ কেজি আম রফতানি করেছেন ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি ও সুইডেনে। এবছর তার রফতানি টার্গেট রয়েছে ২০০ মেট্রিক টন।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএম/জেআইএম