খেলাধুলা

তাসকিন প্রমাণ করলেন রণগিরির উইকেট পেসবান্ধব

‘ডেড ওভারে তার বোলিং ভালো না। কেন তাসকিন আহমেদকে শেষ ওভার করতে দেয়া হলো?’ রণগিরির প্রেসবক্সে  একজন বলে উঠলেন। দেশেও নিশ্চয়ই অমন অনেকেই বলাবলি করছিলেন। তাসকিন অযথা বেশি জোরে বল করতে গিয়ে নির্ঘাত বেশি রান দিয়ে ফেলবে; কিন্তু সেই তাসকিনই যে শেষ ওভারে অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন, তা কে জানত?

Advertisement

যে ম্যাচের প্রথম অংশে বাংলাদেশের বোলাররা শুধুই নিজেদের খুঁজে বেড়ালেন। কারও বলের নিশানা ঠিক ছিল না। ফিল্ডাররা আগের ম্যাচের মতো চিতাসম ক্ষিপ্রতা আর হরিণ চপলতায় লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের শট ঠেকাতে পারেননি। হাত ফসকে ক্যাচও বেরিয়ে গেল।

দুই ওভার আগেই শ্রীলঙ্কার স্কোর গিয়ে ঠেকল ৩০০-তে; এমন এক পরিস্থিতিতে তাসকিন শুরু করলেন তার নিজের নয় নম্বর ও ইনিংসের শেষ ওভার। প্রথম দুই বলে রান উঠল পাঁচ। এর মধ্যে একটি বাউন্ডারি হাঁকালেন আসেলা গুনারত্নে। কিন্তু তারপরই তাসকিন ম্যাজিক। অনবদ্য হ্যাটট্রিক।

পরপর তিন বলে আউট তিন লঙ্কান ব্যাটসম্যান। প্রথম সাজঘরে গেলেন গুনারত্নে। মিড গুড লেন্থ ডেলিভারিকে ৩০ গজের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা মিড অফ ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে মারতে গিয়ে সৌম্য সরকারের হাতে ধরা পড়লেন শেষ দিকে ঝড়ের বেগে ২৮ বলে ৩৯ করা গুনারত্নে।

Advertisement

পরের বলেই আউট সুরাঙ্গা লাকমাল। ফুলটস ডেলিভারি। মিড উইকেটে চালাতে গিয়ে মিড উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকা মোস্তাফিজের হাতে ধরা পড়লেন লাকমাল। হ্যাটট্রিকের শিকার নুয়ান প্রদীপ। নিজে পেস বোলার, তাই শেষ ব্যাটসম্যান কোন ধরনের ডেলিভারিতে দুর্বল তা ভালোই জানা।

সব ভেবে উইকেট সোজা ডেলিভারি। গুডলেন্থে পিচ পড়ে খানিক ভেতরে ঢোকা বলে উপড়ে গেল নুয়ান প্রদীপের উইকেট। যে ম্যাচের বড় সময় মনে হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডেতে করা ৩২৪ রান টপকে যাবে শ্রীলঙ্কা, সেই ম্যাচের শেষ তিন বলে শূন্য রানে আউট তিন লঙ্কান। ক্রিকেট খেলাটাই এমন।

শুধু গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলাই নয়। ভারতীয় তথা বিশ্ববরেণ্য ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রীর ভাষায় ‘ক্রিকেট ইজ এ ফানি গেম।’ সত্যিই ফানি! অবশ্য আজকের ম্যাচ শুরুর আগেও ঘটেছে মজার ঘটনা। কাল রণগিরি স্টেডিয়ামে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল দ্বিতীয় ম্যাচ হবে ঘাসযুক্ত উইকেটে। যেখানে পেসাররা বাড়তি সুবিধা পাবেন। অতিথি দলের জন্য বিভ্রান্ত হওয়ার মতো অবস্থা।

বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ঠই। মাশরাফি শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হননি। আজকের ম্যাচের ২৪ ঘণ্টা আগে হঠাৎ ‘উইকেট’ চলে এসেছিল আলোচনা ও কথাবার্তায়। কাল মধ্যাহ্নে রনগিরিতে প্রেস কনফারেন্সে উইকেটের প্রসঙ্গটা প্রথম নিয়ে এলেন অশাঙ্ক গুরুসিংহে। লঙ্কান ম্যানেজার জানিয়ে দিলেন, ‘আমাদের লাকমালের একটু ব্যথা আছে, তাই আমরা নুয়ান কুলাসেকেরা আর নোয়ান প্রদীপকে দলে নিয়েছি।’ পাশাপাশি তিনি আরও একটি কথা বললেন, ‘উইকেটও মনে হচ্ছে পেসারদের অনুকূল।’

Advertisement

অশাঙ্ক গুরুসিংহের প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পর উইকেট নিয়ে কথা বললেন মাশরাফি বিন মর্তুজাও। মাঠে ঢুকে প্রথম পিচ দেখে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে এসে মাশরাফিও উইকেট নিয়েই প্রশ্নের সন্মুখীন হলেন। প্রশ্ন উঠল উইকেট কেমন দেখলেন?

মাশরাফি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘খানিক ঘাস আছে। তবে উপমহাদেশের পিচে তো খুব বেশি ঘাস থাকে না। এখানেও কাল (আজ খেলার আগে) সকালে পানি ব্যবহার ও রোলার ব্যবহারের পর কতটা থাকবে? সন্দেহ আছে। তবে আমার দেখে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং উইকেটই হবে।’

অধিনায়কের অমন বিশ্বাস থাকলেও পরে বোঝা গেল বাংলাদেশ শিবিরে উইকেটের ওই অল্প কটা ঘাস কিছুটা বিভ্রান্তির জন্ম নিয়েছিল। তাইতো ঘাস আতঙ্কে কাল একাদশ চূড়ান্ত করাই হয়নি। বলা হলো আজ খেলার আগে উইকেট দেখে তারপর ১১ জন ঠিক করা হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত কম্বিনেশনে রদবদল হয়নি। একাদশেও কোন নতুন মুখের সংযোজন ঘটেনি।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই উইকেট নিয়ে একটা খটকা লেগেই ছিল। অবশেষে টাইগার অধিনায়ক মাশরাফির অনুমানই ঠিক। উইকেট মোটেই পেস বোলিং ফ্রেন্ডলি নয়। বরং শতভাগ ব্যাটিং টু ব্যাটিং ট্র্যাক। যেখানে বোলারদের উইকেট পেতে অনেক কষ্ট করতে হলো। উইকেট পাওয়া বহু দূরে, রানের গতি আটকে রাখাই ছিল কঠিন ব্যাপার। রান যা করার তা করেছেন কুশল মেন্ডিস আর অধিনায়ক উপুল থারাঙ্গা।

কুশল ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করে আউট হলেন (১০৭ বলে ১০২)। লঙ্কান অধিনায়ক থারাঙ্গার ব্যাট থেকে আসলো ৭৬ বলে ৬৫। আর শেষ দিকে একটু হাত খুলে ৩৯ করলেন গুনারত্নে। আগের দিন উইকেট পেস সহায়ক উইকেটের কথা যারা শুনেছেন, তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, তাসকিন যখন হ্যাটট্রিকসহ চার উইকেট নিয়েছেন, তখন বোধ হয় উইকেট পেস বোলিং ফ্রেন্ডলিই ছিল।

তারপরও কথা থেকে যায়। বোলারদের বলে নিয়ন্ত্রণ কম ছিল। ‘উইকেটে আমাদের জন্য কিছুই নেই। সুইং, ম্যুভমেন্ট, টার্ন কিছুই নেই। এখানে লাইন-লেন্থটাই আসল। বল ফেলতে হবে লক্ষ্য-পরিকল্পনা মাফিক জায়গামতো এই বোধদয়ে ঘাটতি ছিল। মনে হলো সবাই ধরেই নিয়েছিলেন উইকেটে একটু আধটু সাহায্য পাবো।

কিন্তু তা আর হলো কই? উইকেটের ওপর নির্ভর হতে গিয়ে সবাই আলগা বোলিং করলেন। কারো বোলিংয়ের নিশানা স্থির ছিল না। বেশির ভাগ বোলার প্রচুর বাজে ডেলিভারি ছুড়েছেন। অফ সাইডে বেশি ফিল্ডার নিয়ে লেগ মিডল স্ট্যাম্পে বল ফেলেছেন। আবার কেউ বা অনসাইডে বেশি ফিল্ডার নিয়ে বল করেছেন অফস্ট্যাম্পের বাইরে।

শেষ ওভারে তাসকিন আহমেদের হ্যাটট্রিক বাদ দিলে ফ্রন্টলাইন বোলারদের ব্যর্থতায় ভরা এক ম্যাচ। কেউ কিছু করতে পারেননি। অধিনায়ক মাশরাফি ১০ ওভারে ৫৫ রানে এক উইকেট। সাকিব ১০ ওভারে ৫৯ রানে উইকেটশূন্য। মিরাজ ১০ ওভারে ৫০ রানে এক উইকেট। মোস্তাফিজের অবস্থা আরও খারাপ; ৮ ওভারে ৬০।

একটু নিয়ন্ত্রণ ছিল মিরাজের। তার ১০ ওভারে উঠল ৫০। আর শেষ তিন বলে তিন উইকেটের পতন ঘটানো তাসকিনের নামের পাশে জমা পড়ল চার উইকেট (৪৭ রানে)। বাংলাদেশ একই মাঠে ৭২ ঘণ্টা আগে যে উইকেটে ৩২৪ করেছিল, আজকের পিচ তার চেয়েও ব্যাটিং সহায়ক। সেখানে ৩১১ রান কি খুব বেশি?

শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস শেষে বিরতির সময় বৃষ্টি চলে এসেছে। মাঠকর্মীরা সজাগ ও তৎপর। প্রথম পিচ ও ৩০ গজ ঢাকা হলো। বৃষ্টি শুরুর পর মুহূর্তে রণগিরির পুরো আউটফিল্ড ঢাকা পড়ল নীল কভারে।

এআরবি/এনইউ/আরআইপি