অনেকক্ষণ হল একটা বিজন বনানী পথ ধরে হেঁটে চলেছে মায়া। পুরোনো সব বিশাল গাছের সমারোহ সেই পথের দুধারে। তাদের ঊর্ধ্বগত সতেজ ডালপালাগুলো দুদিক ঘিরে যেন উপড়ে পড়ছে। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় এসে রমণীয় উচ্ছল ডালপালাগুলো একে অন্যের কাঁধে ভর করে অবিভক্ত হয়ে এক নিগূঢ় শুনশান সুড়ঙ্গপথ গড়ে তুলেছে। কতকাল মায়া ওঁর শৈশবসঙ্গী সেই মহীরুহ বটের স্বর্গীয় ছায়ার সংস্পর্শ পায়নি। ওর তেজস্বীনী প্রাণকে ঘিরে এমন প্রশান্তি যেন বিরাজ করেনি অনেককাল। হিমেল হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে এসে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে মায়ার দীপ্তিময় মোহিনী দেহে। যে শাশ্বতী দেহের প্রলুব্ধতার স্পর্ধা করেনি কেউ অনাদিকাল ধরে তার উপর সামান্য তৃষিত বাতাসের এই সীমাহীন অধিকার? যেন এক নিঃসীম প্রত্যয়ের ভববন্ধন সন্ধ্যার এই শুনসান নিরালার প্রতিশ্রুতি আর মায়ার অস্তিত্বের!
Advertisement
আনমনে সামনে এগিয়ে চলেছে মায়া। দীর্ঘপথ শেষে যতো সামনে অগ্রসর হচ্ছে একটা পুকুর দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো। মায়া সে পুকুরের অতি প্রাচীন প্রশস্ত ঘাটের দুএকটা সিঁড়ি বেয়ে মাঝামাঝি সিঁড়িতে এসে বসলো। পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে ইটের ফাঁকেফাঁকে শ্যাওলা আর ছোটো ছোটো পরগাছা জন্মেছে। ঘাটের পাশেই সুদীর্ঘ তালগাছ। পুকুরে তাঁর শিখরের চারপাশের মাটি ভেঙে পড়ায় তালগাছটি উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়েছে পকুরের দিকে। গোধূলির আকাশের রঙিন আলোয় জলের গায়ে যেন তালগাছের রঙিন প্রতিচ্ছবি বিচ্ছুরিত হয়ে উঠেছে। চারিদিকে মনোমোহনীয় নিস্তব্ধতায় ব্যাঙ ডাকছে, ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিমঝিম। আবার মাঝেমধ্যে কিছু পাখি গাছের সান্নিধ্যে নড়েচড়ে উঠছে। হঠাৎ কোন ছোট মাছ কিংবা ব্যাঙ অথবা কি অদ্ভুত সব জলকলরব যে জলের শরীরকে স্পর্শ করে চলছিলো তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।
মায়া গুণগুণ করে উঠলো, "আহা তোমার সংগে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়!" অথচ তেমন কিছুই না। কে এই প্রিয় মায়া জানেনা, জানেনি। জানলে হয়তো ওকে এমন একা, এমন নিঃসঙ্গ হতে হতোনা। নির্বিঘ্নে গুণগুণ করেই চলেছে মায়া। কেউ যেন নিঃশব্দে এসে মায়ার পাশে বসলো। সিঁড়ির উপর ভর করে রাখা মায়ার উষ্ণ মসৃণ বাঁহাতের উপর সেই অনুষঙ্গ তার বাঁহাতখানি রাখতেই মায়া এক স্বপ্নীল সম্মোহন অনুভব করলো। আস্তে আস্তে সেই মায়াবী দোসর মায়ার হাতকে তার দুই হাতের দখলে এনে মুঠিবদ্ধ করে চুপ করে মদির হয়ে চেয়ে আছে মায়ার দিকে। বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ এসে জড়িয়ে ফেলেছে যেন ওদের দুজনকে। ঘাটের পাশের সেই মাধবীলতার সুঘ্রাণ এসে স্পর্শ করছে ওদের নাসিকায়। বর্ষার মৌসুমে, লতার শরীর থেকে থোকায় থোকায় বেরিয়ে, মিষ্টি মধুর গন্ধে আমাদের বর্ষণমুখর দিনগুলোকে মদির করে রাখে এই ফুলেরাইতো তাই না? মাধবীলতা বলেই জানি আমরা এই ফুলগুলোকে। মায়া এসব কোথায় যেন পড়েছিলো মায়ার অনুসন্ধেয় চিত্ত এইমূহূর্তে এইসব ভাবতে চাইছিলো না। লাল ফুলের মাঝে মাঝে সাদা ফুলের ছোপ লাগা ফুলগুলো, যেগুলোকে আমরা মাধবীলতা বলি এর আসল নাম ভ্রম্যলতা। ভ্রম্যদেশ থেকে এসেছিলো বলে এই নামকরণ। ইংরেজিতে এদের রেঙ্গুন ক্রিপার বলে।
মায়া অনুভব করল দুর্দান্ত এক পৌরুষ্য অনুবল। প্রৌঢ় গম্ভীর সেই কণ্ঠের প্লাবণে ভেসে এলো, "দেখো আমি সেই পুরুষ, তোমার সেই প্রেমাকাঙ্খা, যাকে তুমি খুঁজে ফিরছ প্রতিনিয়ত!" সাদা চুরিদারের সাথে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেছে সে, কাজ করা কাশ্মিরী শাল, কলাপুরী সেন্ডেল। কোন সুগন্ধি মাখেনি সে, পাছে মায়া তাঁর প্রাণের সুবাসে নয়, কৃত্রিম সুগন্ধীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ধীরেধীরে মায়ার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো "আমি এসেছি ঠিক তোমার মনের মতো হয়ে, তোমায় প্রীত করবো বলে। তোমায় ভালোবাসতে দেবে আমায়?" কি আশ্চর্য আবেগজড়িত, প্রেমাসক্ত সেই কণ্ঠ। মায়ার দুচোখ ইতিমধ্যেই যেন নজরুলের সেই টলমল জলমতির মালা বুনতে লাগলো। সম্মুখে পূর্ণিমার চাঁদ বারবারই চলন্ত মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাবার পাঁয়তারা করছিলো। রাতের গভীরতায় আবার মেঘ কেটে চাঁদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পুকুরের স্বচ্ছ, স্তব্ধ পানিতে জোছনাকুমারী নিজের প্রতিচ্ছবি নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গভীর রাত অব্ধি নিজের রূপের আলো ছড়াতে ব্যস্ত। পুকুরের ঘাটকে আলোকিত করে ওদের এই রাতকে স্বার্থক করে তুলতে জোছনাকুমারী ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে যেন। আশেপাশে ফুল আর বৃক্ষলতাকে ঘিরে জোনাকিরা ওদের আলোকবিম্বের আহ্বান দিয়ে উড়ে উড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে। মায়া বুঝতে পারছেনা প্রেমের অগোচরে একি প্রেমানন্দ, এ কোন প্রেমানলের খেলা বিরাজ করছে। সেই প্রৌঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, "আমার নামটা অদ্ভুত, এমন নাম আর খুঁজে পাবে কিনা জানিনা। আমার নাম কিরীট বর্ধন। আমি পশ্চিমবাংলার পথযাত্রী। এ পথে যাচ্ছিলাম, শুনলাম কোন এক প্রেয়সীর প্রেমাদ্র আর্তনাদ। আমি আর একদণ্ড এগোতে পারিনি, আমিওযে সেই ভালোবাসারই কাঙাল।"
Advertisement
আহা চাঁদ! এই আষাঢ়মাসে কেউ তোর জোছনার মূল্য দেয় কি? তবু চাঁদ আকাশ জাগিয়ে রাখে। বিশাল আকাশের বুকে এক বিরল জোছনাকুমারীর যেন একটাই কেবল স্বপ্ন, যদি কেউ কোনদিন এই জাগতিক কৃত্রিমতাকে উপেক্ষা করে, এই নির্জনতার প্রাচীর ভেঙে তার জোছনার জলে ঝাঁপ দিতে আসে!! আজকের চাঁদটা যেন অন্যরকম। কিছুটা স্নিগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধকর। প্রকৃতির কি এক অবাধ লীলা, কি মুগ্ধকর, কি বিস্ময়ে ভরা। কিরীট বর্ধন এক সিঁড়ি নিচে নেমে মায়ার ঠিক মুখোমুখি সামনের সিঁড়িটাতে এসে বসলো। মায়ার বাঁহাত ওর বাঁহাতের মধ্যে মুঠবন্দি করলো। মায়ার বাঁহাতের পাঁচ আঙুলকে জড়াজড়ি করে আছে ওর বাঁহাতের পাঁচ আঙুল, দুজনের বাঁহাতের তালু মুখোমুখি। কখনো আলতো, কখনো গভীর দুজনের বাঁহাতের সেই সঙ্গম। মায়াকে ও কিছু প্রশ্ন করলো না। মায়ার কোলে মাথা রেখলো কিরীট বর্ধন। মায়া জানেনা কে এই পুরুষ যাকে সে সব দিতে চায় কিন্তু কিছুই দিতে পারেনা। এই কি সেই পুরুষ যাকে হারাবার ভয়ে মায়া কোনদিন পাবার আকাঙ্ক্ষাও করেনা। নিজের উপর মায়ার কিসের এই অবিচার?
এই নতুন দিনের, নতুন অনুভূতির, নতুন এই উচ্ছ্বাসে মনেই হচ্ছেনা আজই ওদের এই প্রথম কথা হচ্ছে। যেন গতকাল কথা বলার পরও এমনই মনে হচ্ছিলো। মায়া কেবলই ভাবছে, কি সেই জীবনশক্তি, যা দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে হঠাৎ দুজনের কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচিতির উচ্ছ্বাস এনে দেয়? চারপাশের যা কিছুই মায়ার কাছে এতোদিন গুরুত্ববহন করেছিলো সেইসবই আজ এক মুহূর্তে তুচ্ছ হতে লাগলো। কিরীট বর্ধন ওর সমস্ত অস্তিত্ব, সকল মনোযোগ অধিকার করে নিয়েছে এক মুহূর্তে। কিভাবে সম্ভব? মায়া জানে এসব ভেবে কোন লাভ নেই, সম্পূর্ণ অবান্তর এই ভাবনা। সে শুধু এটুকু মানে প্রতিমুহূর্তে মায়ার এই ভালোলাগা, ভালোবাসা নতুন হয়ে উঠেছে। তাঁকে মায়া নতুন করে পায়, এক স্বর্গীয় অর্বাচীন প্রেমের স্বাদ পল্লবিত হতে থাকে মায়ার সমস্ত অস্তিত্বকে ঘিরে। তারপর সেই ভালোলাগার রেশ কাটতে না কাটতেই যেন আবার আরেক নতুন মায়ার জন্ম হতে থাকে। দুজন নতুন মানুষ মিলে একজন নতুন মানুষের মধ্যে একে অন্যকে আবিষ্কারের চেষ্টা। এই চেষ্টা ফুরোবার আগেই ওরা দুজনই যেন ফুরিয়ে যায় এক অনৈসর্গিক অধীরতায়। মায়ার অদ্ভুত লাগছে, একরকম চাপা ব্যথা আছে, কিন্তু অস্থিরতা নেই কিছুতেই। মায়ার উদ্দীপ্ত কল্লোলিত অনুভূতিগুলো প্রেমকেও যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো প্রেমের বিভিন্ন স্তরে উঠানামা করছে। প্রেমের নিত্য নতুন স্তরে। মায়া ভাবছে কে এই পুরুষ? যদি বলে এ তার কল্পনা মাত্র, বিশ্বাসযোগ্য হবে? মায়ার ভেতরে প্রতিদিন যে রক্তক্ষরণ হয় যদি বলে সে শুধু পশ্চিমবাংলার এই কিরীট বর্ধনেরই জন্য, সেকি বিশ্বাস করবে? ভোর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। পূব আকাশে রক্তিম আভা এঁকে দিয়েছে যেন কেউ। বর্ষার ঘনঘটা নেই একেবারেই বলতে গেলে। ঝকঝকে দীপ্তিময় একটা সকাল। প্রভাতের প্রার্থনার সুর ছুঁয়ে গেলো যেন ধরণীর অন্তর্লীন আনন্দলোককে। পাতারা জ্বলে উঠলো স্তব্ধ ধ্যানের আড়ালে। প্রতিটা পাতার নিবেদনে আছে যেন ইন্দ্রপুরীর উৎকর্ষ আর চিত্তশুদ্ধির এক আকুল আহুতি।
কিরীট বর্ধন মায়ার কাছে আর কোনো স্বপ্ন নয়, মায়ার মতই সত্য সে। সকাল গড়িয়ে মধ্যাহ্ন হতেই মায়া চোখ বুজে দেখতে পেল একটা অফিস ঘরে একটা কাঠের টেবিলের উপর অনেক ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে বসে কিরীট বর্ধন কাজ করছে। চারিদিকে প্রচুর লোকজন ঘিরে বসেছে ওকে। ওর অফিসের দালানটার চারিদিকে, বারান্দায়, ছাদে টবে অজস্র সব পাতাবাহার আর ফুলের গাছ। কোথাও ইট, বালি, লোহা এক পাশে স্তূপীকৃত করে রাখা। মায়ার মনে হলো হয়তো ওদের অফিসের কাজ চলছে। ওকে দেখছিলো আর মায়া ভাবছিলো আদৌ কি কোনোদিন তরুণ ছিলো এই কিরীট বর্ধন? কি বলতো তখন ও নিজের সম্পর্কে? কি পরতো? পাঞ্জাবি, পায়জামা, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা? মাথায় সাদাকালো চুলের একপাশে সিঁথি কাটতো? না, তরুণের সাদাপাকা চুল হবে কেন? পরক্ষণেই ভাবে ধ্যাত, কি আসে যায়? তখন হয়তো কিরীট বর্ধনকে এখনের মতো মায়ার ভালোই লাগতো না।
আসলে কি বয়সের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে যে প্রাজ্ঞতা জন্মায় ওটাই মায়ার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে দুর্লভ আর আকর্ষণীয় জিনিস। সময়ের আগে কোন তপস্যার দ্বারাও যাকে পাওয়া অসম্ভব। কিরীট বর্ধনের কাছে যাবার, ওর সাথে কথা বলবার, ওকে দেখবার ইচ্ছা মায়ার মধ্যে এতো তীব্রতর হয়ে উঠে মাঝেমধ্যে। মায়া ভাবছে এমন আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্রয় দেবার কোনো মানে নেই। এমন অস্থিরতা মানুষকে আরো অস্থির করে তুলে। তার চাইতে একটা ছোট্ট ভাবনা মায়ার দিনরাতের প্রতিটা মুহূর্তকে যেভাবে উপভোগ্য আর তৃপ্তিময় করতে পারে, কঠিন রূঢ় বাস্তবতা তা কোনোদিন পারবে না। এজন্যই মানুষ তার স্বপ্নের পিছনে ছুটে। একটা ভাবনার বাস্তব রুপ দিতে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। মানুষ মানুষের দিকে ছুটলে ক্লান্ত হয়। মায়া জানে এখানেই ওর স্বস্তি, ওর স্বপ্নের এই জগতই একমাত্র সত্য। যেমন সত্য পশ্চিমবাংলার কিরীট বর্ধন আর তার মুগ্ধকরা পৌরুষত্ব, ওর মণপ্রাণ কাড়া স্নিগ্ধ হাসি, ওর ঐশ্বর্যময় ব্যক্তিত্ববোধ।
Advertisement
মায়া আশেপাশে খুঁজে ফিরছে কিরীট বর্ধনকে। কেউ নেই, মায়া নিঃসঙ্গ বসে আছে সিঁড়িতে। তাহলে সারারাত ধরে যা ঘটেছিলো এইসব কিছুইকি সত্য নয়? মায়া উঠে সামনের দিকে এগোতেই দেখে কিরীট বর্ধন আসছে একবোতল মিনারেল ওয়াটার আর এক প্যাকেট এনার্জি বিস্কিট হাতে। মায়া কিছুই বুঝতে পারছেনা কি ঘটছে। কিরীট বর্ধন বলে উঠলো, "কি ভূত দেখছো নাকি? দোকানটা খানিকটা দূরে, তাই চা আনতে পারিনি। এই নাও পানি আর তোমার প্রিয় এনার্জি বিস্কিট!" মায়া বললো, "আপনার আমার পরিচয় হলো গতরাতে। এনার্জি বিস্কিট যে আমার প্রিয় আপনি জানলেন কি করে?" কিরীট বর্ধন মায়ার কপালে ওর কপাল দিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে উত্তর করলো, "আমি তোমার সব জানি মেয়ে!" মায়া পানি আর বিস্কিটের প্যাকেট হাতে ধীরে ধীরে আবার সেই নিগূঢ় শুনসান বুনো পথের গভীরে মিলিয়ে গেলো। আবার সেই একই পথে, সম্পূর্ণ একা, মায়ার একান্ত সেই একাকিত্বের জগতে।
এইচআর/পিআর