মতামত

মানুষের মৃত্যুও ‘নাটক’ কিংবা ‘বায়োস্কোপ’?

সিলেটের শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলের ঘটনা আপনাকে কী শিক্ষা দিয়ে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকম। সরকার ও সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা একটি সফল অভিযানের মাধ্যমে সবচেয়ে কম সংখ্যক প্রাণহানি ঘটিয়ে ৭৬ জন সাধারণ নাগরিকের জীবন রক্ষা করেছেন এবং চারজন জঙ্গিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। একমাত্র রাষ্ট্রের শত্রু ছাড়া কেউ একথা বলার সাহস পাবে না যে, সিলেটের এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো অবহেলা ছিল।

Advertisement

যদিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলিতে সেনাবাহিনী তথা সোয়াট, র্যা ব বা পুলিশের কৌশল নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলছেন, কিন্তু সেগুলো আমাদের জাতীয় চরিত্রের অংশ বলেই আমি করি। কারণ, আমরা প্রত্যেকেই সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে অন্যের কোনো পদক্ষেপই আমাদের ভালো লাগে না। কথা সেটি নয়, কথা হলো, সিলেটের এই আতিয়া মহলের ঘটনা যে গত বছর হোলি আর্টিজানের ঘটনার পরে নুতন করে আমাদেরকে একথাই বলে গেলো যে, জঙ্গি নামক শ্বাপদ দেশ ও জাতিকে চারদিক থেকে আক্রমণ করেছে এবং অচিরেই হয়তো এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে রাষ্ট্রকে, তাতে কারো কোনো সন্দেহ আছে কি?

এ লেখার পাঠক হয়তো ভাবছেন যে, এ আবার কোনো প্রশ্ন হলো নাকি? অবশ্যই জঙ্গিবাদ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, এমনকি রাষ্ট্রের জন্যও এক বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ নিয়ে নতুন করে আবার প্রশ্ন তোলার কী আছে? নিশ্চয়ই পাঠক, আপনিই ঠিক। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই এটিও লক্ষ করেছেন যে, দেশের এক সময়কার সরকারি দল, তারপর বিরোধী দল এবং এখন একটি আপাদমস্তক ক্ষমতাকামী দল বার বার দেশের ভেতর চলমান জঙ্গি আক্রমণকে নাটক হিসেবে আখ্যা দিয়ে এ বিষয়ে এমন কটু মন্তব্য করছে যে, আপনার মনে হতে পারে, জঙ্গি নাটকের কুশীলব আসলেই তারাই, নাহলে যে নাটকে সাধারণ মানুষের, সেনা সদস্যদের, পুলিশ সদস্যদের, র্যা ব সদস্যদের জীবননাশ ঘটছে তা কী করে তাদের কাছে নাটক হয়? একমাত্র নাটকের নাট্যকারই বলতে পারেন যে, তিনি বা তারা নাটক করছেন, বাকিরাতো আর জানে না বা জানতে পারছে না যে, কেউ এই নাটক ঘটাচ্ছে আড়ালে থেকে, তাই নয়?

আচ্ছা আমরা ধরে নিচ্ছি তাদের কথাই ঠিক, জঙ্গিবাদ একটি নাটক কিংবা বিএনপি-নেতা রুহুল কবীর রিজভি’র বক্তব্য অনুসারে জঙ্গিবাদ একটি ‘বায়োস্কোপ’ যা সরকার বার বার জনগণকে দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই নাটক বা বায়োস্কোপ দেখিয়ে সরকারের কী লাভ হচ্ছে? জনগণকে ভয় দেখিয়ে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে সরকার আসলে জঙ্গি ইস্যু থেকে কী লাভ পেতে পারে তার একটি বিশ্লেষণ আমরা আশা করতেই পারি বিএনপি’র কাছ থেকে। কিন্তু তারা একে নাটক বা বায়োস্কোপ আখ্যা দিয়েই খালাশ, কোনোরূপ ব্যাখ্যা আমরা তাদের কাছ থেকে পাইনে। আমরা এই ব্যাখ্যাও আজ অবধি পেলাম না যে, কেন তারা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নয়।

Advertisement

আমরা কখনওই জানি না যে, ২৭শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে কী করে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হন, যখন ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকাকে শ্মশ্মাণে পরিণত করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী? আমরা তাদের কাছ থেকে বুঝতে চেয়েছি যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার কী করে ইসলাম ধর্মের ওপর আঘাত হয়? সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকার যদি জঙ্গিবাদ নামক একটি নাটক বা বায়োস্কোপ জনগণকে দেখিয়েও থাকে তাহলে তারা কেন এই নাটকের পর্দাটি ফাঁস করে দিচ্ছেন না? তার চেয়েও বড় কথা হলো, কেন বিএনপি জঙ্গিবাদকে ক্রমাগত অস্বীকার করে যাচ্ছে, যখন কেবল বাংলদেশ নয়, গোটা বিশ্বই এই দানবের শিকারে পরিণত হয়েছে? দুঃখজনক সত্য হলো, যখন এদেশে বাংলা ভাইয়ের উত্থান ঘটেছিল তাদেরই সমর্থন ও সহযোগিতায় তখন তারা বলেছিল যে, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। যখন আলেক্স পেরী বা বার্টিল লিন্টনার নামের বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে নিবন্ধ লিখেছিল তখন তারা একে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে সেগুলো প্রত্যাখ্যানই শুধু নয়, এদেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, দোভাষীদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নামিয়ে এনেছিলো।

সারা দেশের আদালতসহ একযোগে ৬৪টি জেলায় বোমা বিস্ফোরণের পরও তাদেরকে বিশ্বাস করানো যায়নি যে, এদেশে জঙ্গি আছে। এসবের কারণ কি? এর কারণ হলো, ইতোমধ্যেই এদেশে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি-জামায়াত সরকারে থাকাকালে তাদের মন্ত্রীরাই এই জঙ্গিবাদের উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন নিজেদের স্বার্থে, ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য সন্ত্রাসবাদকে তারা মূলতঃ একটি ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে কাজে তারা সফল হননি, জনগণের চাপে ক্ষমতায় থাকতেই তাদেরকে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের বিচার করতে হয়েছিল। প্রশ্ন হলো দেশে যদি জঙ্গিবাদ বর্তমান সরকারের সাজানো নাটক বা বায়োস্কোপই হবে তাহলে কেন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতার শেষ সময়ে এই জঙ্গিদের বিচার করেছিল? কেন তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল? হয় তখন তারা ভুল করেছিল নয়, এখন তারা ভুল করছে- পাঠক আপনার যুক্তি কী বলে?

ফিরে যাই সেই প্রশ্নে যে, জঙ্গিবাদকে পুঁজি করে সরকারের আসলে কী লাভ? আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, জঙ্গিবাদকে পুঁজি করে সরকারের কোনো লাভ নেই, বরং চরম লোকসান। কারণ কোনো নাটক বা বায়োস্কোপই বেশিদিন অনুদ্ঘাটিত থাকে না, কখনও না কখনও তা ফাঁস হবেই। আমরা বরং হেফাজতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত নিয়ে তার সমালোচনা করছি অনবরত, পাঠ্যপুস্তকে যে সব পরিবর্তন আনা হয়েছে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী তার প্রতিবাদ করছি এবং বার বার সরকারকে একথাই বলছি যে, কোনো ভাবেই ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতের ফল ভালো হয় না, হতে পারে না। বরং বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, বহু ধর্ম ও বর্ণের মানুষের নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সরকারের ওপর রয়েছে তার বিপুল সমর্থকদের নিরন্তর চাপ। এখন সরকার সেই চাপকে অগ্রাহ্য করে নির্বাচনী প্রচারণায় নামার মতো বোকামি করছে বলে আমাদের অনেকেরই মনে হচ্ছে।

এমতাবস্থায় জঙ্গিবাদ নাটক করে সরকার তা থেকে কী ফায়দা লুটতে পারে তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু এ বিষয়ে কারোরই সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য আমরা পাচ্ছিনে, যা আগেই বলেছি। সাদা চোখে এরকম কোনো নাটক বা বায়োস্কোপেতো সরকারের ক্ষতিই হওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি, এবং যারা বিশ্বাস করেন যে এটি সরকারের নাটক তারাতো সরকারকে রীতিমতো গালাগালই দিচ্ছেন, তাহলে সরকার কেন সাধ করে এই গালাগাল বা সমালোচনা ঘাড়ে নেবে এবং সেটা তখনই যখন সরকার একটি নির্বাচনী প্রচারণার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে? জানি, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আপনার বা আমার এই নাটক-তত্ত্ব বা বায়োস্কোপ-তত্ত্ব বোধগম্য হবে না, তাই ব্যাখ্যাটি আসতে হবে বিএনপি নেতাদের কাছ থেকেই, তাই নয়?

Advertisement

কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চাইতেও একটি গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমরা সবাই জানি যে, লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হামলার উদ্দেশ্যে পরিচালিত জঙ্গি আক্রমণে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। পৃথিবীময় এই হামলার নিন্দা হয়েছে এবং প্রত্যেকেই একবাক্যে একথা বলছেন যে, পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, এর তীব্র নিন্দা জানানো উচিত এবং প্রতিটি দেশকেই এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বিশ্ব নেতাদের পক্ষ থেকে। ঠিক সে সময়ই বাংলাদেশের সিলেটে আতিয়া মহলে জঙ্গিরা প্রায় শ’ খানেক মানুষকে জিম্মি করে রাখার ঘটনা ঘটছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জীবন বাজি রেখে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। ৭৬ জন মানুষকে অক্ষত উদ্ধার করার মতো ঘটনা এ পৃথিবীতে আর একটিও নেই, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেটি করে দেখিয়েছে। তাদেরকে উদ্ধার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ জনগণের ৬ জন প্রাণ হারিয়েছে পৃথক পৃথক বোমা হামলায়।

পুরো ঘটনাই লন্ডনে ঘটা জঙ্গি হামলার মতোই মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতম হামলা হিসেবে পৃথিবীময় নিন্দা হয়েছে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, বিএনপি নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে জঙ্গি হামলায় নিন্দা জানালেন, নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানালেন এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ঝাড়লেন, কিন্তু সিলেটের আতিয়া মহলের ঘটনায় নিহতদের প্রতি সমবেদনা তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের প্রতি কোনো আহ্বান জানানোর প্রয়োজনও তিনি বোধ করলেন না। রাজনীতি এমনই এক অন্ধ ও নিন্মস্তরের বস্তু যে, মানুষের মৃত্যু সেখানে কোনো বিষয়ই নয় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, তাদেরকে এমন নেতৃত্বকেই প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে মেনে নিতে হয় বা ভবিষ্যতেও হতে পারে। যার কাছে দেশের মানুষের জীবননাশ নাটক বা বায়োস্কোপ মাত্র!

এদেশে আমরা কোনো ব্যাপারেই একমত হতে পারি না। এমনকি এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কিংবা জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয় তা নিয়েও মোটা দাগে বিতর্ক রয়েছে। অনেকদিন থেকেই একথা বলে আসছি যে, এগুলো থেকে বের হতে না পারলে এই বিতর্কের পারদ উঠতেই থাকবে এবং আখেরে লাভবান হবে শত্রুপক্ষ। এখন প্রশ্ন করুন, এই শত্রুপক্ষ কারা? এক কথায় তার উত্তর দেয়া প্রায় অসম্ভব, কিন্তু কেউ যদি এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চান তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই একথা বলবেন যে, এই শত্রু আর কেউ নয়, যে বা যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সে বা তারাই, এরা দেশি হলে দেশি, বিদেশি হলে বিদেশি।

পাঠক নিজেকে এবার প্রশ্ন করুন, আসলেই দেশের শত্রু কারা এবং কেন? আপনি হয়তো একমত নাও হতে পারেন সরকারের জঙ্গি দমন বিষয়ক পদক্ষেপ নিয়ে, কিংবা মনে করতেও পারেন যে, এটি সরকারের সাজানো নাটক, কিন্তু এই নাটকে যারা প্রাণ হারালেন তারাতো আপনার কাছে সম্মান, সমমর্মিতা, ভালোবাসা দাবি করতে পারে, কি পারে না?  ঢাকা, ২৮ মার্চ, মঙ্গলবার ২০১৭

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/পিআর