শিক্ষা

হিসাব দিতে অনাগ্রহী অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) জমা দিচ্ছেন না।

Advertisement

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৫টি। এর মধ্যে মাত্র ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে। বাকি ৭৭টির অডিট রিপোর্ট অনিয়মিত। আইনের তোয়াক্কা না করায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিওটি (বোর্ড অব ট্রাস্টি) সদস্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারবে না। আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে। এ প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এ ধারা লঙ্ঘিত হলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের নির্দেশনা রয়েছে।

৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। আইনের ১৪, ২৫ ও ২৬ ধারা অনুযায়ী, অর্থ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করতে হবে।

Advertisement

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ কমিটির কোনো সভা হয় না। নেই কোনো কোষাধ্যক্ষ। যেখানে কোষাধ্যক্ষ আছে, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের পছন্দের লোককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

আইনের তোয়াক্কা না করে বিওটি সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে সংরক্ষিত তহবিলের (ফান্ড) বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন তারা- এমনও অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট ক্যাটাগরিতে মোট ১২ জন সিন্ডিকেট সদস্য রয়েছেন। মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য একজন সিন্ডিকেট সদস্য মাথাপিছু সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী নিচ্ছেন। প্রমোদ ভ্রমণের জন্য অনেক সময় বিদেশেও সিন্ডিকেট মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। এভাবে বিভিন্ন বৈঠকের নামে বিওটির সদস্যরা সম্মানীর নামে বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কেনাকাটাতেও চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি। ইউজিসির তদন্ত রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গত বছর ইউজিসি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে হস্তান্তর করে। এতে সনদ বিক্রি, সিন্ডিকেটের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণাখাতসহ ১৬ ধরনের আর্থিক দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

Advertisement

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৯৫টি। এর মধ্যে গত বছর ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয় ছিল প্রায় দুই হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আয় করেছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। অপরদিকে, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যয়ও করেছে প্রায় দুই হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। আয়-ব্যয় সমান দেখিয়েছে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়। আয়-ব্যয় কীভাবে সমান হয় তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ইউজিসির।

ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, প্রায় দুই যুগ আগে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি)। ২৩ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট ইউজিসিতে জমা দেয়নি। আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়টির হিসাব নিরীক্ষা করানো হয় কিনা, সে তথ্যও ইজিসিতে নেই। একইভাবে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ২৩ বছরের কোনো অডিট রিপোর্ট নেই। পুন্ডু ইউনিভার্সিটির নেই ১৬ বছরের, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ১১ বছরের, রয়েল ইউনিভার্সিটির ১৩ বছরের অডিট রিপোর্টের তথ্য নেই।

এ ব্যাপারে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সিএ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট) ফার্মের মাধ্যমে হিসাব নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা। সিএ ফার্ম নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যে কারণে প্রতিবেদন দাখিল করা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া অন্য কেউ সিএ ফার্ম চেয়েছে কিনা, তাও আমাদের জানা নেই।

১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট রিপোর্ট হালনাগাদ

৯৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষিত অডিট রিপোর্টের হালনাগাদ তথ্য রয়েছে। এগুলো হলো- আমেরিকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, হামদর্দ ইউনিভার্সিটি, ঈশাখাঁ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (সৈয়দপুর)।

হালনাগাদ নেই দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের অডিট রিপোর্ট নেই। ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করতে সিএ ফার্ম আপত্তি দিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিএ ফার্মের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অডিট রিপোর্ট নিয়েও আপত্তি আছে। ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরের অডিট রিপোর্ট নেই। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির ২৩ বছরের অডিট রিপোর্ট নেই। ছয় বছরের অডিট রিপোর্ট নেই আন্তজার্তিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের। আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ বছরের অডিট রিপোর্ট নেই। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ১৩ বছরের অডিট রিপোর্ট নেই। দি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের চার বছরের, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ বছরের, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের চার বছরের, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক বছরের, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, লিডিং ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ১০ বছরের, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের সাত বছরের, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ১৭ বছরের, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গত দুই বছরের, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের নয় বছরের, ইবাইস ইউনিভার্সিটির ছয় বছরের, সিটি ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, নর্দান ইউনিভার্সিটির ১০ বছরের, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের এক বছরের, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ছয় বছরের।, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) চার বছরের, সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির চার বছরের, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার সাত বছরের, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাত বছরের, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সাইন্সেস এর দুই বছরের, অতীশ দীপংকর রয়েল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছয় বছরের, আশা রয়েল ইউনিভার্সিটির দুই বছরের, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ১৭ বছরের, ইউরোপীয়ান ইউনিভার্সিটির দুই বছরের, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির চার বছরের, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, ফাস্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটির এক বছরের, জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছরের, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের, ফেনী ইউনিভার্সিটির এক বছরের, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চার বছরের, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির চার বছরের, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের, টাইমস ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, রাজশাহী সাইন্স এ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, জার্মান ইউনিভার্সিটির তিন বছরের, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির দুই বছরের, সিসিএন ইউনিভার্সিটির দুই বছরের।

অডিট রিপোর্ট প্রক্রিয়াধীন সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির, গত বছরের রিপোর্ট প্রক্রিয়াধীন আছে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (কাদিরাবাদ), আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (কুমিল্লা)।

৯৫টির মধ্যে সাতটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষা কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।

প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মান্নান বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন অডিট ফার্মের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হয়। সকলের সে প্রতিবেদন দেয়া বাধ্যতামূলক। কেউ যদি তা অবহেলা করে তবে তাদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হবে। যথাযথ কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালকে সুপারিশ করা হবে।

এমএইচ/এমএআর/আরআইপি