অর্থনীতি

এখনই বিনিয়োগের সময়

মো. মোবারক হোসেন ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন ২ লাখ টাকা। দুই মাস না ঘুরতেই সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ। এরপর জমি বিক্রির পাঁচ লাখ এবং প্রবাসী শ্যালকের ২ লাখ টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করেন। মাস খানেক ভালোই চলল। ১ লাখ টাকার মতো মুনাফা তুললেন।

Advertisement

তবে এরপরই বিধিবাম। ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজারে দেখা দিল ধস। সেই ধস একপর্যায়ে রূপ নিল মহাধসে। ২ লাখ টাকার উপরে মুনাফা থাকা মোবারকের বিও হিসাবে তেমন টাকা নেই। ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হিসাবটিতে সবমিলিয়ে রয়েছে ৩ লাখ টাকা। ঘটনাটি ২০১২ সালের।

জমি বিক্রি ও প্রবাসী শ্যালকের টাকা বিনিয়োগ করে পুঁজি হারানো মোবারককে মোকাবেলা করতে হয় পারিবারিক নানা সমস্যা। পোর্টফোলিওতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে অর্ধেক টাকাও পাওয়া যাবে না- তাই শেয়ার বিক্রি করে টাকাও উঠিয়ে নেননি।

এ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) বিশেষ কোটা সুবিধা ঘোষণা করে সরকার। পুঁজি ও আস্থা হারা এ বিনিয়োগকারী আবার বিনিয়োগ করেন শেয়ারবাজারে। তবে এবার আর সেকেন্ডারি মার্কেটে নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী হিসেবে নতুন নতুন আইপিওতে আবেদন করতে থাকেন।

Advertisement

এরপর একে একে চলে যায় তিনটি (২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫) বছর। আইপিওতে আবেদন করে যে শেয়ার পেয়েছেন তা বিক্রি করেছেন সেকেন্ডারি মার্কেটে। তবে এ তিন বছর সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে কোনো শেয়ার কেনেননি। ২০১৬ সালে এসে শেয়ারবাজার কিছুটা থিতু হলে আগস্ট মাসের দিকে আবার সেকেন্ডারি মার্কেটে অল্প অল্প শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় শুরু করেন মোবারক। সেই সঙ্গে কমতে থাকে লোকসানের পাল্লা। আর চলতি বছরের তিন মাসের ঊর্ধ্বমুখী বাজারের কল্যাণে অতীতের লোকসান কাটিয়ে কিছুটা মুনাফারও মুখ দেখেছেন।

শুধু মোবারক হোসেন নন, শেয়ারবাজারের মহাধসে পুঁজি হারানো অনেক বিনিয়োগকারী দীর্ঘ অপেক্ষার পর সাম্প্রতিক সময়ের ঊর্ধ্বমুখী বাজারের কল্যাণে কিছুটা লোকসান পুষিয়ে নিয়েছেন। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই ইতিবাচক ধারায় ফেরার ইঙ্গিত দিতে থাকে শেয়ারবাজার।

তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসের পর থেকেই মূলত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে শেয়ারবাজার। চার হাজার পয়েন্টের ঘরে ঘোরাঘুরি করা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছোট ছোট উত্থানে সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গেছে। ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে থাকা লেনদেন চলে এসেছে হাজার কোটি টাকার উপরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের পর শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক। প্রচণ্ড আস্থা সংকটে শেয়ারবাজারের পতন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। সরকারের উপর মহলের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে আস্তে আস্তে সেই সংকট প্রায় কেটে উঠেছে।

Advertisement

তারা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের পর বেশ কয়েকবার বাজার এমন ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। তবে এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মুদ্রাবাজারের সামগ্রিক চিত্র শেয়ারবাজারের অনুকূলে। সঞ্চয়পত্র, এফডিআইসহ সব ধরনের আমানতের সুদের হার বেশ কম। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের খুব বেশি বিকল্প উৎসও নেই। ফলে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসা অনেকটা স্বাভাবিক।

প্রায় দেড় বছর ধরে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান অথবা বড় ধরনের পতন দেখা যায়নি। এতে বাজারের ওপর প্রায় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে আসছে। অস্বাভাবিক উত্থান-পতন না থাকায় বিনিয়োগকারীদের লোকসান দিয়ে বাজার ছাড়তে হচ্ছে, গত দেড় বছরে ধরে এমন খবর শোনা যাচ্ছে না। আর সম্প্রতি ব্যাংকের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। কারণ, ব্যাংকগুলো বাজারে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন বাড়লে পুঁজিবাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক। সূচক কোন দিকে যাচ্ছে, সূচক খুব বড় আকারের ওঠা-নামা করছে নাকি মোটামুটি স্থিতিশীল, বাজারের তারল্য কী রকম? যেকোনো বাজারেই এ তিনটি বিষয় পর্যালোচনা করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ের বাজার চিত্রে দেখা যাচ্ছে এ তিনটি বিষয়ই ইতিবাচক। বাজারে বড় ধরনের কোনো উত্থান-পতন নেই। ছোট ছোট উত্থানে বাজার এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ‘জেড’ গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ না করে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো করে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করতে হবে।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের আমানত রেখে ৫ থেকে ৭ শতাংশের বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ শেয়ারবাজারে বুদ্ধি খাটিয়ে বিনিয়োগ করতে পারলে ১০ শতাংশের উপরে মুনাফা পাওয়া সম্ভব। এদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে ব্যাংকে আমানত রাখার থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা পাওয়া সম্ভব।

ডিএসইর অন্য পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, দেশে এখন কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা নেই। মুদ্রাবাজারের চিত্রও শেয়ারবাজরের জন্য ভালো। সামষ্টিক অর্থনীতিও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। তবে বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ খুব একটা হচ্ছে না বলে আমার ধারণা। যারা আগে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতেন তারাও এখন ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় চলে এসেছেন। শক্তিশালী শেয়ারবাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা- এটা আমি বলতে পারব না। তবে বাজারের যে চিত্র তাতে বোঝা যাচ্ছে বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আসছে এবং যথেষ্ট তারল্য রয়েছে। বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী যেমন প্রয়োজন, তেমনি ডে-ট্রেডারদেরও প্রয়োজন। কারণ তাদের মাধ্যমেই বাজারে তারল্য বাড়ে।

বাজার মূলধনচলতি বছরের প্রথম কার্যদিবস ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ২৩ মার্চ লেনদেন শেষে তা দাঁড়ায় তিন লাখ ৭৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। লেনদেন হয়েছে ৫৯ দিন। অর্থাৎ ৫৯ কার্যদিবসে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।

সূচক ও লেনদেনবছরের শুরুতে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৮৩ পয়েন্টে। আর লেনদেন ছিল ৯৯৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ২৩ মার্চ লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭২৬ পয়েন্টে। আর লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। চলতি বছর লেনদেন হওয়া ৫৯ কার্যদিবসের মধ্যে ৪১ দিনই মূল্য সূচক বেড়েছে। আর প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার উপরে। এর আগে ২০১০ সালে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে এতো টাকার লেনদেন হয়।

ব্যাংকের শেয়ারশেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে পরিচিত ব্যাংকিং খাত। তবে ২০১০ সালের ধস এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর শেয়ারবাজারে ব্যাংকের প্রভাব কমতে থাকে এবং একপর্যায়ে তা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তবে চলতি মাস থেকে আবারও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলো। শেষ চার কার্যদিবসে মোট লেনদেনে ব্যাংকিং খাতের অবদান ছিল ৩০ শতাংশের ওপর, যা ২০১৬ সালের শেষে ছিল ৯ শতাংশের মতো।

আসছে নতুন বিনিয়োগকারীবাজারে বর্তমানে বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৪৯টি, যা ২০১০ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২৯ লাখ ৪০ হাজার ১২১টি। গত তিন মাসে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার বেড়েছে। বিও হিসাবের এ চিত্র থেকেই বোঝা যায় আতঙ্ক কেটে যাওয়ায় নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসছেন।

এমএএস/এমএআর/পিআর