জাতীয়

দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭০-এর ওপরে

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে ৭০ বছর ১ মাসে পৌঁছেছে। পাঁচ বছর আগে এই আয়ু ছিল ৬৭ বছর ২ মাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে ২০১৩ সালে পাওয়া গেছে এই গড় আয়ু। একই সঙ্গে শিশু ও মাতৃমৃত্যু, শিক্ষার হারসহ আর্থসামাজিক অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ এগিয়েছে। জনসংখ্যার বিভিন্ন মৌলিক সূচকের ওপর বিবিএসের `মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ` (এসভিআরএস) জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এ জরিপ শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে বিবিএস। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতির প্রভাব পড়েছে গড় আয়ু ও অন্যান্য সূচকে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) এখন বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার অন্যান্য অনেক স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় বেশি হারে কমেছে। দারিদ্র্য বিমোচনই আয়ু বৃদ্ধির মূল কারণ। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূর-উন নবী মনে করেন, গড় আয়ু বৃদ্ধির মূল কারণ দারিদ্র্য বিমোচন। দারিদ্র্য কমলে মৃত্যুহার কমে। আর মৃত্যুহার কমলে মানুষের আয়ু বাড়ে। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। এসব অগ্রগতি আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। এ ছাড়া সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, এক দশকে রেকর্ড দারিদ্র্য কমেছে। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সরকারের ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগে মহামারী রোগ কমে গেছে। একই সঙ্গে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এসব কারণে আর্থসামাজিক অনেক সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এর প্রভাবে গড় আয়ু বেড়েছে। বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায়ও বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে ২০০৯ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৭ বছর ২ মাস। সেটি ২০১০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ বছর ৭ মাস। এর পরের বছর ৬৯ বছর হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছর ১ মাস, যা ২০১২ সালে ছিল ৬৯ বছর ৪ মাস। তবে পুরুষের চেয়ে নারীদের আয়ু বেশি। পুরুষের গড় আয়ু যেখানে ৬৮ বছর ৮ মাস, সেখানে নারীদের ৭১ বছর ৪ মাস। নারীদের গড় আয়ু পাঁচ বছর আগে ২০০৯ সালে ছিল ৬৮ বছর ৭ মাস। বাংলাদেশে প্রতি ১০ বছর পর আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। তবে শুমারি-পরবর্তী বছরগুলোতে জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান হালনাগাদের জন্য বিবিএসের প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জনসংখ্যা ও জনতাত্ত্বিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরিতে সহযোগিতা করে বিবিএস। নমুনা নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে প্রতি বছর তথ্য হালনাগাদ করে বিবিএস। এসভিআরএস প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক বলেন, দেশের মাতৃমৃত্যু হার, শিশুমৃত্যু হার, গড় আয়ুষ্কাল, শিক্ষার হার, বয়স্ক শিক্ষা, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, আগমন, নির্গমন, বহির্গমন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, প্রতিবন্ধী, এইচআইভিসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামজিক সূচকের তথ্য সংগ্রহ করা হয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে; যাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভুল না হয়। আর্থসামাজিকের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। ২০০৯ সালে এক হাজারে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটত ৫০টি। এর পরের বছর কমে দাঁড়ায় ৪৭। ২০১২ সালে ছিল ৪২ জন। ২০১১ সালে ছিল ৪৪ জন। এক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নিচে ছেলেশিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৪২ জনে দাঁড়িয়েছে। ২০১২ সালে সূচক ছিল ৪৩ জন। অন্যদিকে মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৩-তে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮। দেশের শিক্ষার হারও বেড়েছে বলে বিবিএসের প্রতিবেদেনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে শিক্ষার হার (১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব ) ৬১ শতাংশ, যা ২০১২ সালে ছিল ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে ছিল ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরুষের ক্ষেত্রে শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, তিনটি কারণে বাংলাদেশের আয়ুষ্কাল ও আর্থসামাজিক সূচক বেড়েছে। এর মূল কারণ দারিদ্র্য কমে যাওয়া। এর বাইরে পুষ্টি সচেতনতা ও নারী শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এক দশক ধরেই আর্থসামজিক সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শিশুমৃত্যু হার ও মাতৃমৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে কিছুটা বেড়েছে। এ হার দাঁড়িয়েছে বার্ষিক এক দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা ২০১২ সালে ছিল এক দশমিক ৩৬ শতাংশ। ২০১১ সালে ছিল এক দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০১০ সালে ছিল এক দশমিক ৩৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে ছিল এক দশমিক ৩৬ শতাংশ।এসআরজে

Advertisement