মতামত

প্রিয় বাংলাদেশ আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার

সেদিন এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি কথায় কথায় বলছিলেন, ‘বাঙালি অতি অসভ্য জাতি। আমরা সভ্যতা শিখেছি ব্রিটিশদের কাছ থেকে। আমাদের কোনো সাহিত্য ছিল না, দর্শন ছিল না। আমরা কাপড় পরতেও জানতাম না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রলোক এই দেশেই জন্ম নিয়েছেন। আজও পর্যন্ত ইউরোপ বা আমেরিকা ভ্রমণ করেননি। কিন্তু তিনি পাশ্চাত্যের শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতির ব্যাপক ভক্ত এবং যেকোনো সুযোগে বাঙালির নিন্দা করতে পারলে খুশি হন।

Advertisement

এমন ব্যক্তির সংখ্যা কিন্তু এদেশে কম নেই। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আছেন এমন অনেকে। এদের উদ্দেশ্যে প্রথমেই বলতে চাই গ্রিস ও রোমান সভ্যতা ছাড়া ইউরোপের একটি বড় অংশের জনগণ যখন বনবাসী ছিল তখনই কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডে আমরা গড়েছি নগরসভ্যতা। আমি উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়াতে বসিনি। কিন্তু আমাদের দেশ এবং এর গৌরবময় ইতিহাস বিষয়ে জানার প্রয়োজন। আমাদের রয়েছে তিনহাজার বছরের ইতিহাস।

খ্রিস্টপূর্ব দেড়হাজার বছর আগে বাংলাদেশের নগর সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে নরসিংদীর ওয়ারি বটেশ্বর গ্রামে। এখানে এক প্রাচীন দুর্গ নগরীর অস্তিত্ব ছিল।  একই সমসাময়িক সভ্যতা হলো পশ্চিমবঙ্গের পান্ডুরাজার ঢিবি নামে পরিচিত নগরের চিহ্ন।  খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকে গঙ্গাহৃদি নামে শক্তিশালী একটি দেশ ছিল গঙ্গার অববাহিকায়। গঙ্গারাইডিস বলে যাদের উল্লেখ রয়েছে, প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে তাদের অতি দুধর্ষ জাতি বলা হয়েছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর অববাহিকায় এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা রাজ্যটির নাম ছিল ‘গঙ্গা-হৃদি’ বা ‘গঙ্গা-হৃদয়’। তাদের রাজধানীর নাম ছিল গঙ্গে। এই অঞ্চলের রাজার হস্তিবাহিনী ছিল, ছিল নৌবহর। শুধু তাই নয়, তারা ছিল দক্ষ তীরন্দাজ। এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের ভয়ে গ্রিকরা এ অঞ্চল জয় করতে প্রয়াসী হয়নি।

বঙ্গ জাতির নাম উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে ও অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে। বাঙালি জাতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য সমূহে এই অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘বং’ বা ‘বঙ্গ’ এবং ‘আল’ বা জমির সীমানা প্রাচীর থেকে বঙ্গাল, বাংলা ইত্যাদি নামের উদ্ভব। মহাভারতে ও শতপথ ব্রাহ্মণে ‘বঙ্গ’ দেশের উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গের রাজা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন তার বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এমনটি বলা হয়েছে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে।

Advertisement

সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ ছিল স্বাধীনচেতা। তারা আর্যশাসনকে সহজে মেনে নেয়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রারম্ভে এই অঞ্চলে যে রাজ্যগুলোর নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, কামরূপ, পুন্ড্র, রাঢ় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণবঙ্গে চন্দ্রদ্বীপের নামও পাওয়া যায় যার অধিবাসী ছিলেন চর্যাপদের কবি মীননাথ।

প্রসিদ্ধ ইতিহাস গবেষক ড.নীহার রঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইতে আমরা প্রাচীন বাংলার জনজীবনের যে ছবি খুঁজে পাই তা বেশ শান্তিপূর্ণ এক সমাজের ইঙ্গিত বহণ করে। গ্রামীণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে এদেশের গ্রামগুলো ছিল ছোট ছোট প্রশাসনিক এককে বিভক্ত। কার্ল মার্কস তাঁর ‘ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জী’তেও ভারতবর্ষের(বাংলাসহ) গ্রামীণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উল্লেখ করে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজের কথা বলেছেন।

এদেশের গ্রামে কৃষকরা সোনার ফসল ফলাতো। নদী ভরা ছিল মাছ। ধান, সরিষা, তিল, তিসি ইত্যাদি ফসলের ফলন ছিল। বাঙালির খাদ্য ছিল মূলত ভাত ও মাছ। সঙ্গে থাকত নানারকম সবজি, মিষ্টান্ন। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল ছিল বস্ত্রবয়নে পারদর্শী। বাংলার তাঁতী বা বস্ত্রশিল্পীদের হাতে বোনা সুক্ষ্ণসুতি বস্ত্র মিশরে ও গ্রিসে পর্যন্ত রপ্তানি হতো। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ছিল সুদক্ষ নাবিক। জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও আমাদের খ্যাতি ছিল। সপ্তডিঙা, মধুকর সাজিয়ে বাংলার সওদাগররা চলে যেতেন দূর সাগর পাড়ি দিয়ে সিংহলসহ বিভিন্ন দেশে।

প্রাচীন বাংলায় এসেছিলেন অনেক দেশের পর্যটক। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ বৃত্তান্তে প্রাচীন বাংলার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে বাংলার এই ভূখণ্ডকে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ও শান্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়। যদিও চর্যাপদের কবিদের কয়েকজনের পদে দরিদ্র মানুষের অভাবের চিত্রও কিছুটা রয়েছে। ফা হিয়েন বাংলায় এসেছিলেন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে। ৬০০ ক্রিস্টাব্দের দিকে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক বাংলার স্বাধীন নরপতি ছিলেন। তিনি বাঙালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মগধ থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত ছিল তার রাজত্ব। বাংলার বিজয় সিংহ শ্রীলংকায় সিংহল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

Advertisement

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে চীন সম্রাট তাই সুং আখের চাষ ও চিনি উৎপাদন পদ্ধতি শিক্ষার জন্য বাংলায় একদল ছাত্রকে পাঠান। তার মানে তখন চীন থেকে বাংলায় শিক্ষালাভ করতে শিক্ষার্থীরা আসতেন।  আরেক চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩৫ সালে বাংলার সমতটে আসেন। তিনি বাঙালি দার্শনিক ও মহাপণ্ডিত শীলভদ্রের নাম উল্লেখ করেছেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ছিলেন তিনি। হ্যাঁ, সেই সময়ই বাঙালিরা প্রতিষ্ঠা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়। এমন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ভিন্ন দেশ থেকেও পড়তে আসতো বিদ্যার্থীরা। সেখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল দশহাজারের উপরে। সেখানে ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, ভাষা, সাহিত্যা, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সংখ্যাবিদ্রা ইত্যাদির চর্চা হতো।

আমি এখানে বাংলার ইতিহাস লিখতে বসিনি। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমাদের নিজেদের ইতিহাস নিয়ে, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি নিযে আমাদের গৌরব বোধ থাকা প্রয়োজন। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো মহাপণ্ডিত, ধীমান পালের মতো শিল্পী বাংলাদেশেই জন্মেছিলেন। ধর্মপাল, বল্লাল সেন, দিব্য কৈবর্তের মতো নৃপতিরা বাংলার সিংহাসনে বসেছেন। আমাদেও দেশেই ভাষা আন্দোলন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও এদেশেই জন্মেছেন। জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভা। আমরা যদি আমাদের অতীত ইতিহাস বিষযে না জানি তাহলে সবসময়েই হীনম্মন্যতায় ভুগবো। বিশ্ব ইতিহাস যেমন জানা প্রয়োজন তেমনি নিজের দেশের গৌরবময় ইতিহাসও জানতে হবে।

২৬ শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস মানেই শুধু লাল সবুজ কাপড় পরে ঘুরে বেড়ানো নয়। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন অগণিত মানুষ, শহীদ হয়েছিলেন ৩০ লাখ , গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন দুই থেকে চার লাখ নারী সে দেশটি তো ভুঁইফোড় কোনো দেশ নয়। তিন হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে যে জাতির, তার বিষয়ে অযথা নেতিবাচক মনোভাব দেখাতে হবে কেন?

যতদিন পর্যন্ত আমরা নিজেদের দেশ নিয়ে গৌরব অনুভব করতে না শিখবো ততোদিন বিদেশের কাছ থেকে আমরা সম্মানিত হওয়ার আশা রাখতে পারি না।

এই সুপ্রাচীন ভূমি, প্রিয় বাংলাদেশ আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস