বিশেষ প্রতিবেদন

পুলিশ জাদুঘর যেন জীবন্ত ইতিহাস

নান্দনিক স্থাপনা। থরে থরে সাজানো সব গৌরবের উজ্জ্বল স্মারক। দেয়ালজুড়ে সব দুর্লভ চিত্র। যা দেখে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মস্তক। একেকটা বাঁধাই দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতা যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার কথা। অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার থেকে ভেসে আসা স্বাধীনতার গানে গানে ঘুরতে ঘুরতেও দর্শনার্থীদের শেষ হয় না আগ্রহ।

Advertisement

রাজধানীর রাজারবাগের পুলিশ অডিটোরিয়াম ভবনের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। জাদুঘরে সংরক্ষণ করা প্রত্যেকটি স্মারক সাক্ষ্য দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অজানা সব কাহিনী। গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

শুক্রবার বিকেলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস-এ ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রাঙ্গণে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন এবং স্বাধীনতার প্রথম প্রহর উদযাপন- ২০১৭ উপলক্ষে বইমেলা ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়।

আমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুলিশের আইজি আব্দুল খালেকের স্ত্রী সেলিনা হোসেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে পাগলা ঘণ্টা বাজানো পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলী।

Advertisement

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবরার হোসেনের চোখ আটকে যায় পাগলা ঘণ্টায়। কেন এই পাগলা ঘণ্টা? কে বাজিয়েছিল? কেনই-বা বাজাতে হয়েছিল? প্রশ্নের যেন শেষ নেই তার। একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের।

আবরার পরে এ প্রতিবেদককে জানায়, পাগলা ঘণ্টার শব্দেই সেদিন স্বাধীনতার জন্য প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পুলিশ সদস্যরা। পরে সেই পাগলা ঘণ্টা বাজানো পুলিশ কনস্টেবল মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলীর সঙ্গ পেয়ে ছবি তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে-সহ অন্য শিশুরা।

বঙ্গবন্ধু গ্যালারি দিয়ে শুরু হওয়া পুলিশ জাদুঘরটি দুর্লভ সব ছবি আর পোস্টারে পরিপাটি সাজানো। অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর শুরু হয় ১৯৭৫ সালে পুলিশ সপ্তাহে দেওয়া তাঁর ভাষণ। ভাষণ শুনতে শুনতে মুখে তা আওড়াতে শুরু করেন একাদশ শ্রেণির ছাত্র মেহরাব। পরে তিনি বলেন, ৭ মার্চের স্বাধীনতার ভাষণ শুনলে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

জাদুঘরের নিচের (ভূগর্ভ) তলার গ্যালারি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে সাজানো। ‘লেটার ডিস্ট্রিবিউশন বক্স’, পাগলা ঘণ্টা, পুলিশের পোশাক, প্রথম আইজি’র ব্যবহৃত সব পোশাক, পুলিশের ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়ি যা স্বাধীনতার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল। দেয়ালজুড়ে সাজানো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরদের ব্যবহৃত রাইফেল, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, ইউনিফর্ম, চশমা, মানিব্যাগ ও সার্চলাইট।

Advertisement

জাদুঘরে দায়িত্বপালনকারী এএসআই (সহকারী উপ-পরিদর্শক) শহীদুল ইসলাম জানান, এখানে নানা শ্রেণি ও পেশার দর্শনার্থীরা আসেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইমেলা থাকায় শিশু-কিশোরদের আগ্রহ আজ বেশি। এছাড়া অতিথিদের আগমনে তা আরও বেগবান হয়েছে।

জাদুঘর পরিদর্শন শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে জানতে চান, এ জাদুঘরে কি স্বাধীনতার যুদ্ধে সকল পুলিশ সদস্যের আত্মত্যাগের বিষয়টি উঠে এসেছে। উত্তরে তিনি বলেন, চেষ্টা সত্ত্বেও তা এখনও সম্ভব হয়নি। তবে স্বাধীনতার এতো দিন পর হলেও আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি তার পরিপূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এখন আর কেউ পুলিশের ভূমিকাকে খাটো করে দেখতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধটা পুলিশ সদস্যরাই শুরু করেছিল এই রাজারবাগে। আজ এখানে স্মৃতির এ সমারোহ দেখে আমাদের গৌরবের ইতিহাস নতুন প্রজন্ম শিখতে ও জানতে পারবে। তারা গড়বে সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বুধবার বাদে সপ্তাহে ছয় দিন খোলা থাকে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। দুপুর ১টায় এক ঘণ্টার বিরতি। সবার জন্য উন্মুক্ত এ জাদুঘর। টিকিটের মূল্য ১০ টাকা।

জেইউ/এমএআর/আরএস