বিশেষ প্রতিবেদন

‘তার’ পাগলা ঘণ্টার ধ্বনিতে শুরু প্রথম প্রতিরোধ

চারদিকে গুমোট নীরবতা। দেশে না জানি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কী হতে যাচ্ছে বোঝার উপায় ছিল না। অস্থিরতা নিয়ে রাজারবাগের ভেতরে পায়চারী করছিলেন ২১ বছরের টগবগে যুবক আব্দুল আলী। হঠাৎ গায়েবি আওয়াজে কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাক দিলেন ‘আব্দুল আলী’। এরপর আবার অস্থিরতা নিয়ে পায়চারী। অন্ধকার যেন আরও ঘনিয়ে আসছিল ১২টার পরপরই। খবর আসে রাজারবাগ আক্রমণের। তখন রাজারবাগে ছিলেন না কোনো কর্মকর্তা। কাউকে না পেয়ে নিজেই পাগলা ঘণ্টা বাজান কনস্টেবল আব্দুল আলী।

Advertisement

পাগলা ঘণ্টার শব্দ শুনেই রাজারবাগের সালামি গার্ডে জড়ো হতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। এরপর গুলি করে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তারা। সেই রাতে প্রথম অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আব্দুল আলী।

রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠের উত্তর-পূর্ব কোনে অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘরে জাগো নিউজের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণণা দেন আব্দুল আলী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের আইজি তসলিম উদ্দিনের বডিগার্ড ছিলেন তিনি। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আব্দুল আলী কনস্টেবল পদে যোগ দেন ১৯৬৭ সালে। আনসার প্রশিক্ষণে গিয়ে ভাগ্যক্রমে পুলিশে সুযোগ পান। এরপর ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান এ সৈনিকের খোঁজ মেলে ২০১০ সালে।

আব্দুল আলী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সেদিন বেলা ২টা পর্যন্ত ডিউটির পর বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যায়। মিছিলে মিছিলে উত্তাল রাজধানী। রমনা, শাহবাগ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিস্থিতি জানান দিচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। রাজারবাগে ফিরতে বেজে যায় রাত সাড়ে ৯টা। থাকতাম ৬ নম্বর ব্যারাকের তৃতীয় তলায়। ভবনটির নিচতলায় জেলা পুলিশের অস্ত্রাগার। ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে পায়চারী করতে করতে পুকুর পাড়ে যাই। কিন্তু অস্থিরতা কমছিল না।

Advertisement

অস্থিরতা চেপে ক্যানটিনে রাতের খাবার খেতে গিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। রাত তখন ১০টা ১০ মিনিট। বিদ্যুৎ যাবে কেন? কিছুই মিলছিল না। অন্য পুলিশ সদস্যরাও তার মতো উদ্বিগ্ন। সিঁড়ি ধরে তৃতীয় তলায় উঠে চারপাশ দেখে নেন। পুলিশ লাইনস এলাকার কোথাও আলো নেই। অন্ধকারে পুরো শহর।

আব্দুল আলী বলছিলেন, খবর নিতে ছুটে যাই টেলিফোন অফিসে। কিন্তু টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। পুকুরপাড়ে এসে সন্দেহ হয়, ওয়ারল্যাস অফিসের দিকে যাই। হঠাৎ একটা মোটরবাইক ঢুকে পড়ে ১ নম্বর গেইট দিয়ে। বাইকের আলো পড়ে মুখে। তীব্র আলোয় কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।

আব্দুল আলী বলেন, বাঙ্গালি পুলিশ ভেবে বাইকচালক জানান, রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনারা আজ রাতে আক্রমণ করবে। বঙ্গবন্ধু সমস্ত পুলিশ সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাকে এ বার্তা পুলিশ সদস্যদের পৌঁছে দিতে বললেন। কথা শেষ করে চলে যেতে থাকেন আরোহী। পরিচয় কী— জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল।’

সাধারণ কনস্টেবল আমি। ভেবে পাই না কী করে এ খবর পৌঁছাবো। কিন্তু রাজারবাগে আক্রমণ হবে এটা মানতে পারছিলাম না। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিল। হঠাৎ ‘ম্যাগাজিন গার্ড, ম্যাগাজিন গার্ড’ বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে যাই ৬ নম্বর ব্যারাকে। দায়িত্বে থাকা সেন্ট্রিকে বলি কোথায় হাবিলদার গার্ড? তিনি বলেন, জানি না। এরপর ‘হাবিলদার গার্ড, হাবিলদার গার্ড’ বলতে বলতে ভবনের সিঁড়ি পেরিয়ে তিন তলায় উঠে যাই কিন্তু কোনো কর্মকর্তার সাড়া মেলে না।

Advertisement

নিচে নেমে অস্ত্রাগারের সামনে ঝোলানো পাগলা ঘণ্টার কাছে যাই। লোহার লম্বা একটা দণ্ড হলো পাগলা ঘণ্টা। রেললাইনের পাতের একটি অংশ। এ ঘণ্টা বাজালে পুলিশ সদস্যরা যে যেখানে, যেভাবেই থাকেন না কেন, হাজির হন সালামি গার্ডের সামনে।

আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ তুমিই জানো। জানি না কী করতে যাচ্ছি। যা হবার হবেই। সাহসটুকু দিও। এ দোয়া করেই পাগলা ঘণ্টায় আঘাত করতে থাকি।

এরপর পুলিশ সদস্যরা জড়ো হতে থাকেন সালামি গার্ডের সামনে। এক সেন্ট্রিকে ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দিয়ে যাই অস্ত্রাগারের চাবি আনতে। রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের (আরআই) অফিসে গিয়ে দেখি তালাবদ্ধ। চলে যাই বাসায়। বাসার দরজায় তালা ঝোলানো।

আব্দুল আলী বলেন, সেন্ট্রিকে বললাম, বাবা আর দেরি করো না। ভাঙো এ তালা। গুলি করে ও শাবল দিয়ে তালা ভাঙা হলো। শহীদবাগ, ফকিরাপুল, শরীফবাগ ও মাটিরবাগ এলাকা ধরে সারি সারি সাজানো থ্রি নট থ্রি রাইফেল-গুলি পুলিশ সদস্যদের হাতে তুলে দিই।

সোয়া ১২টার দিকে শুরু হয় প্রতিরোধ। ফকিরাপুলমোড় দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকছে। আমরা অবস্থান নিয়ে আছি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে যখনই ১০/১২টা গাড়ি আসছে তখনই আমরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি করি। শহীদবাগ এলাকায় ওরা ঢুকতে পারেনি। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা তুমুল লড়াই চলে। ক্যান্টনমেন্ট জানতো না আমরা এতো শক্ত অবস্থানে আছি। তাদের (পাকিস্তানি সৈন্য) এক ঘণ্টা লেগেছে আসতে। রাত ১টার পর এমনভাবে যুদ্ধ শুরু হলো, মর্টার শেল পড়ে রিজার্ভ অফিসে আগুনে লেগে গেল। আমরা আগুনের তাপে থাকতে পারছিলাম না। বের হতে পারছিলাম না। এভাবে চলে ফজরের আজান পর্যন্ত।

ভোরের দিকে ক্রলিং করে চলে যাই পুলিশ টেলিকম ভবনের পাশে, এখন যে পুকুর রয়েছে সেখানে। তারপর সুযোগ বুঝে চলে যাই পুলিশ হাসপাতালে। হাতের অস্ত্র হাসপাতালের বিছানার তোষকের নিচে রাখি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালেই সেদিন কেটে গেল। বাইরে কারফিউ। বের হওয়ার উপায় নেই। একসময় সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়ি। চলে যাই কমলাপুরে। সেখান থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ। পরে টানা পাঁচ দিন পায়ে হেঁটে পৌঁছাই ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জে।

বর্তমানে ৬৭ বছর বয়স আব্দুল আলীর। সেই রাতে তিনি ছিলেন ২১ বছরের তেজদীপ্ত টগবগে যুবক। প্রাণ হাতে নিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম প্রতিরোধের পাগলা ঘণ্টার বাদক তিনি। পুলিশে এক অনুপ্রেরণার নাম আব্দুল আলী।

জেইউ/এমএআর/আরএস