একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর দীর্ঘ সাত বছরে সংশ্লিষ্ট অপরাধে দায়ের করা ২৭টি মামলায় অভিযুক্ত প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
Advertisement
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা বাঙালি জাতিসত্তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর চালিয়েছিল গণহত্যা। তাই ভিকটিম ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবির মুখে স্বাধীনতার ৩৯তম বছরে ২৫ মার্চ গণহত্যার বিচার কার্যক্রম শরু হয়েছিল মানবতাবিরোধী এ আদালতে।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিতর্কিত করতে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অপপ্রচার চালানো হয়। দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র ও বাধা উপেক্ষা করে সাত বছরে জামায়াত-বিএনপির প্রভাবশালী নেতাসহ ২৭টি মামলার আটক ও পলাতক দুর্ধর্ষ ৪৯ আসামির দণ্ড ঘোষণা করা হয়। প্রথমে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং পরে তৃণমূল পর্যায়ের রাজাকারদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে শান্তি কমিটি, রাজাকর এবং জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সরকার।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তদন্ত সংস্থায় এখন পর্যন্ত সর্বমোট অভিযোগ আছে ৬৯৭টি। এর মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে ৪৯টির। তদন্ত প্রক্রিয়াধীন আছে ২৬টির এবং প্রসিকিউশনে দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন আছে ১১টির। ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে আরও ১০টি মামলা। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল থেকে দণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণার পর রায়ের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলায় করা আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
Advertisement
ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, জাতির এক বিশাল প্রত্যাশার সঙ্গে বর্তমান সরকারেরও নির্বাচনী ইশতেহার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সরকার সেটাই পালন করে যাচ্ছে। সাত বছরে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। এটি বাংলাদেশের একটি বড় জয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনে প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হলেও পর্যায়ক্রমে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে।
তদন্ত সংস্থার প্রধান আব্দুল হান্নান খান আরও বলেন, সরকারের দায়িত্ব হলো আইন পাশ করা। আর মূল কাজটি তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনালকে করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের প্রথম অধিবেশনেই যুদ্ধাপরাধের বিচারে আইন পাশ করে। এরপর বিচারের জন্য কোর্ট (মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল) গঠন করা হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ।
তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিরলস প্রচেষ্টায় ধারাবাহিক কাজ করে যাচ্ছি। যদিও নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে আমাদের কাজ চলছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে এসে বিচার শুরু করে তা বাস্তবায়ন করা চারটিখানি কথা নয়।
আসামিদের অবস্থান পরিবর্তন
Advertisement
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর আগে থেকেই অনেক অপরাধী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। তাই আসামিদের খোঁজ খবর নিয়ে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবীদের হিমসিম খেতে হয়।
এ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান আরও বলেন, একাত্তরের পরে যখন বিচার শুরু হয় তখনই অনেক অপরাধী নেপাল হয়ে পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যায়। এমন অনেক তথ্য তদন্ত সংস্থার কাছে আছে। বর্তমানে তৃণমূলের রাজাকারদের বিচারে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ আসামি পালিয়ে যাওয়া একটি জটিল সমস্যা।
হান্নান খান বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে যেসব রাজাকার ছিল তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায়, তাদের অপরাধের জায়গা একটি কিন্তু বর্তমানে অবস্থান করছেন ভিন্ন জায়গায়। ধরুন গফরগাঁওয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আর তাদের পাওয়া যাচ্ছে নীলফামারীতে। নেত্রকোনায় অপরাধ করেছেন কিন্তু বিয়ে করে অবস্থান করছেন কক্সবাজারে। এসব আসামিদের তথ্য খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে তাদের অর্থবল, লোকবল এমনকী আন্তর্জাতিক লোকবলও বেশ শক্তিশালী।
সাক্ষী সুরক্ষা আইন ও সাক্ষ্যগ্রহণে সমস্যা
সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকাতে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হাজির করতে বেশ পরিশ্রম করতে হচ্ছে- এমনটি উল্লেখ করে হান্নান খান বলেন, প্রথম দিকে আমরা সাক্ষীই খুঁজে পেতাম না। ওই সময় সাক্ষীরা ভয় পেতেন। বিচার হবে কি হবে না, এ ভাবনায় তারা সাক্ষ্য দিতে চাইতেন না। এখন ট্রাইব্যুনাল থেকে বেশকিছু মামলায় আসামিদের সাজা কার্যকর হওয়ায় সাক্ষীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। তবে সাক্ষী নিরাপত্তা আইন না থাকায় আমাদের এখনও বেগ পেতে হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধ বিষয়টি যেহেতু একটি সেনসিটিভ বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা তেমন পাই না। অনেক সময় সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায় না। কোন কোন জায়গায় রেসপনসও মেলে না। তবে কিছু কিছু জায়গা বেশ রেসপনস করে। আমাদের সাক্ষীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ সাক্ষীই গরিব। তাদের অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতে হয়।
সাক্ষীদের জন্য কিছু করা দরকার- উল্লেখ করে তদন্ত সংস্থার প্রধান বলেন, সরকারের কাছে আমার একটি দাবি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যারা ইতিহাস গড়েছেন, সেই ইতিহাস রক্ষায় যারা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন তাদের জন্য কিছু করা। যেসব মামলা শেষ হয়েছে, সেসব মামলার সাক্ষীদের জন্য সরকারের উচিত কিছু করা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের ভালো কিছু উদ্যোগ আছে। আমাদের সাক্ষীদের জন্যও তেমন ভাতা চালু করা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, যে দিবসটি আমরা এখন থেকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছি সেই দিন থেকে গণহত্যার বিচার শুরু হলো। এটি একটি অসাধারণ বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্ম একদিন জানবে, যে দিনে গণহত্যা শুরু হয়েছিল সেই দিনে গণহত্যার বিচার শুরু হয়। যা ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা।
তুরিন আফরোজ বলেন, ট্রাইব্যুনালের সাত বছর বেশ সময়। তবে এ সময়ের মধ্যে ২৭টি মামলায় অর্ধশত আসামির বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এটি বড় ব্যাপার। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা যে অর্জন করেছি তাতে আমার মনে হয় এটি শুধু দেশবাসীর জন্য নয়, বাঙলি জাতির জন্য নয়; এ জয় মানবসভ্যতার।
হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা পৃথিবীতে বিরল। সুতরাং আজকের জয় যদি হয়ে থাকে তাহলে আমি এটা দেখবো মানবসভ্যতার জয় হিসেবে বলেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বিচারপতি নিজামুল হককে চেয়ারম্যান, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদকে সদস্য করে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর আরও তিনজনকে যোগ করে প্রথম ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ টি এম ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করে ২০১২ সালের ২৩ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়।
এফএইচ/এমএআর/আরএস