দেশজুড়ে

রাতের আঁধারে মরদেহ মই দিয়ে টেনে গণকবর দিয়েছি

সেই ভয়াল ও বীভৎস কালরাত্রির স্মৃতিবাহী ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন।

Advertisement

একাত্তরের অগ্নিঝরা এই দিনে বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। এ রাতে বর্বর পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

একাত্তরের বর্বর গণহত্যার সাক্ষী শেরপুরের সোহাগপুর বিধবাপল্লী। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের তাদের দোসর আলবদর রাজাকাররা মাত্র ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে সোহাগপুরের ১৮৭ জন মানুষকে হত্যা করে।

শেরপুর জেলা সদর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের নিভৃতপল্লী সোহাগপুর। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই এই গ্রামে ঘটে নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞ। ওই ঘটনায় ৬২ জন নারী বিধবা হন।

Advertisement

নির্যাতনের শিকার হন আরও অনেক নারী। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবাপল্লী’। নৃশংসতার যে ইতিহাস সেদিন সৃষ্টি হয়, তা কোনো দিন ভুলতে পারবে না সোহাগপুরবাসী।

সোহাগপুর গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী আলবদর কমান্ডার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৭টি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগ ছিল সোহাগপুরে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ।

অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। পরে ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১’ সোহাগপুর বিধবাপল্লীকে ‘সোহাগপুর বীর কন্যাপল্লী’ নামে ঘোষণা করে।

Advertisement

সেদিনের সেই বিভীষিকার সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন ৩২ জন বিধবা। সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী, গ্রামবাসী, কয়েকজন বিধবা ও শহীদ পরিবারের সন্তানের সঙ্গে।

তারা জানান, ওদিন ছিল শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ। সকাল ৭টার দিকে গ্রামের মানুষ খেতে-খামারে গিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

এ সময় পাকহানাদার বাহিনীর প্রায় দেড়শ’ জনের একটি দল আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল্ল দিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে।

এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। অনেককেই বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।

মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠানে ফেলে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। প্রায় ৬ ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর ত্যাগ করে চলে যায়।

স্বজনদের মরদেহ দেখে শুরু হয় শোকের মাতম। তাদের আত্মচিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠে। আবার হানাদার পাকবাহিনী আসবে বাড়িঘর জ্বালাতে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রিয় স্বজনের মরদেহ কেউ কলপাতা, কেউ শাড়ি-গামছা, আবার অনেকেই ঘরের মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে গর্ত করে এক কবরে ৫-৭ জনকে মাটিচাপা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। সোহাগপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ চলাচল ছিল। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছেন।

সেই হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী সোহাগপুরের মো. শাহাব উদ্দিন (৭৫) বলেন, গরম বালুর মধ্যে যেমন মানুষ মুড়ি ভাজে, ঠিক সেভাবে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকে গুলি ছুড়েছে। যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই গুলি করে হত্যা করেছে। সে সময় পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পাই।

শহীদ সিরাজ আলীর স্ত্রী বিধবা সমলা বেওয়া (৮০) শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার স্বামী সিরাজ আলী পাকবাহিনীর কাছে জোড়হাত করে বাঁচার মিনতি করেছে। কিন্তু তারা ছাড়েনি। ঘর থেকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আমার পরিবারের পাঁচজনকে ঠিক একইভাবে মেরেছে তারা।

সোহাগপুর বিধবাপল্লী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জালাল উদ্দিন (৬০) বলেন, সেদিন আমার বাবাসহ পরিবারে সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়। স্থানীয় রাজাকার আবদুল কাদির আকন্দের সহযোগিতায় জামায়াতের সেক্রেটারি কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তরের ২৫ জুলাই সোহাগপুরে চলে এই গণহত্যা। সেইদিনের স্মৃতি একটা দুঃস্বপ্নের মতো। রাতের আঁধারে মই দিয়ে আমরা মরদেহ টেনে নিয়ে গণকবর দিয়েছি।

কাকরকান্দি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জিয়াউল হোসেন মাস্টার বলেন, সোহাগপুর গ্রামে পাকবাহিনীর গণহত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা।

কাকরকান্দি-বরুয়াজানি এলাকার ঘরে ঘরে তখন ছিল মুক্তিযোদ্ধা। সোহাগপুর বেনুপড়া প্রফুল্ল দিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা ঘিরে পাকহানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় সুপরিকল্পিতভাবে এই গণহত্যা চালিয়েছে।

সোহাগপুর গণহত্যায় আমার এক ভাই জহুরুল ইসলাম শহীদ হয়েছেন। এটি ছিল বর্বর গণহত্যা। এলাকার পুরুষ মানুষদের যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড।

হাকিম বাবুল/এএম/আরআইপি