১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালির জীবনে নেমে আসে পৃথিবীর নৃশংস এক অন্ধকার রাত। মুক্তিকামী মানুষকে রুখতে ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু হয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ।
Advertisement
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় গণহত্যা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আশ্রমে ঢুকে হত্যা করেছিল কীর্তনরত ৮ সাধুকে।
বিজয়ের আগ পর্যন্ত ৯ মাস অবরুদ্ধ ছিল ফরিদপুর। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করে পাকসেনারা। ওই ৯ মাসে ফরিদপুরে অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়।
শহরের শ্রীঅঙ্গন, ঈষান গোপালপুর, কানাইপুর, কোমরপুর, বৈদ্যডাঙ্গী, ভাংগীডাঙ্গী, ভাঙ্গা উপজেলার জান্দী, নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া, ঈশ্বরদী, বোয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া ও রাজাপুর রামনগর, আলফাডাঙ্গা উপজেলার মালা গ্রাম এবং মধুখালীর গাজনাসহ সর্বত্র চলে হত্যাযজ্ঞ। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা না গেলেও ওই গণহত্যা থেকে বাদ পড়েনি কেউ।
Advertisement
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে ঘটে ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় গণহত্যা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আশ্রমে ঢুকে হত্যা করে কীর্তনরত ৮ সাধুকে। এই আটজনের বাইরে সেদিন আশ্রমে থাকা সত্ত্বেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এক সাধু। খুব কাছ থেকে পুরো ঘটনাটি দেখেছেন কান্তি বন্ধু ব্রহ্মচারী।
এ বিষয়ে কান্তি বন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, পাকসেনারা ফরিদপুরে প্রবেশের পর কয়েকজন সাধু পালিয়ে গেলে ৯ জন সাধু আশ্রমত্যাগ করতে রাজি হননি। সেদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন বিহারী সহযোগীকে নিয়ে পাকসেনারা আশ্রম ঘিরে ফেলে।
এরপর চারজন অস্ত্রধারী সেনাসদস্য মন্দিরের ভেতর থেকে ৯ সাধুকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে। মন্দিরের পাশেই চালতে তলায় দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে তাদের হত্যা করা হয়। ওই সময় নবকুমার নামের এক সাধু অলৌকিতভাবে বেঁচে যান।
কয়েক বছর আগে ব্যক্তি উদ্যোগে সেখানে নিহত আট সাধুর নাম লিখে আটটি কাল স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। একাত্তরের সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে শ্রী অঙ্গনের ওই জায়গাটিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণসহ নিহতদের শহীদ হিসেবে মর্যাদার দাবি ফরিদপুরবাসীর।
Advertisement
এরপর ২ মে বিকেলে ফরিদপুরে প্রথম পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালায় ঈশান গোপালপুর জমিদার বাড়িতে। ফরিদপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীদাস হাটের পাশে জমিদার শ্রী ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালায় পাকিস্তানিরা।
জেলার জেষ্ঠ্য সাংবাদিক ও নিহত শহীদ পরিবারের সদস্য শ্রী জগদিশ চন্দ্র ঘোষ জানান, তার বাবা, চাচাসহ জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ২৮ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী।
পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৮ জনের মরদেহ মাটিচাপা দিয়ে রাখে। যুদ্ধের দীর্ঘদিন পরেও গণকবরটি সংরক্ষণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেউ।
পরে ২০১০ সালের ২ মে শহীদ পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী মিলে নিহত ২৮ জনের নামফলকসহ একটি স্মৃতিফলক তৈরি করে চিহ্নটি ধরে রাখার চেষ্টা করেন বলেও জানান তিনি।
৮ মে জেলার সদর উপজেলার কানাইপুরে বিহারি ও রাজাকারদের একটি সশস্ত্র দল ওই এলাকার সিকদার বাড়িসহ আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ১৮ জন মানুষকে জবাই করে হত্যা করে।
স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাকসেনারা জেলার সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের বাকচর গ্রামে ১১ জন নিরীহ মানুষকে বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে। পরে মরদেহগুলি রাস্তার পাশে মাটিচাপা দেয় এলাকাবাসী।
’৭১’র ১৬ মে যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর নেওয়াজের নেতৃত্বে তিন শতাধিক পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া ও রাজাপুর রামনগর গ্রামে ঢুকে। সেদিন ওসব এলাকার ৩৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাকবাহিনী। গ্রামে ঢুকে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ করে পাকসেনা ও তাদের দোসররা।
১৯৭১ সালের ৩০, ৩১ মে ও ১ এপ্রিল নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায় স্থানীয় দোসর ও পাকসেনারা। মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, নগরকান্দা, কাশিয়ানীসহ চতুর্দিক থেকে শত শত পাকসেনা গুলি করতে করতে গ্রামে প্রবেশ করে। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। সেদিন ১৮ জন নারীসহ ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেসময় আরও চারজনকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে মারা বলে জানায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
১৪ আগস্ট বোয়ালমারী থানা আক্রমণের পর ১৬ আগস্ট পাকসেনারা গুনবাহা, চাপলডাঙ্গা, চতুল, ছোলনা, বাইখীর, শিরগ্রামের প্রায় ৫০ জন লোককে হত্যা করে।
মধুখালীর উপজেলার গাজনা এলাকায় ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। ’৭১’র জুন-জুলাইয়ের দিকে সদর উপজেলার চরবালুধুমে মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন ও সহযোদ্ধাদের ধরতে কোরবান আলীর বাড়িতে হামলা চালায় পাকসেনারা।
সেদিন দুপুরের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে পিছু হটে গেলেও পরে ওই এলাকার ১৯ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় এবং গোয়ালন্দ ঘাটে জাহাজের ওপর থেকে গুলি করে নদীতে মরদেহ ভাসিয়ে দেয় পাকসেনা ও রাজাকাররা।
’৭১’র পাকসেনাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল তখন ফরিদপুর স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে বর্তমান স্যাটেলম্যান অফিসের নিচতলা পুরুষদের এবং দোতলায় নারীদের রাখা হতো।
সেখানে অসংখ্য নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হতো। কমসংখ্যক লোকই সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছিল। অধিকাংশকেই অমানবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল ফয়েজ বলেন, স্বাধীনতার পরে স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়। সেখান থেকে মানুষের হাড়, কঙ্কাল, মাথার খুলি, নারীদের শাড়ি-কাপড়ের পচা টুকরা এবং শাখা-চুড়ির সন্ধান মেলে। পরে সেখানে মহান মুক্তিযোদ্ধের গণকবরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতের পরে আমাদের জেলায় যেসব গণহত্যা হয়েছে সেই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্থানগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। এছাড়া গণহত্যা সংগঠিত বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ও নান্দনিক করার দাবি জানান তিনি।
এস.এম. তরুন/এএম/আরআইপি