২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত। ১৯৭১ সালের এই রাতে, নিরপরাধ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ভারি অস্ত্র নিয়ে পৈশাচিক হত্যার উল্লাসে মাতে পাকিস্তানি হানাদাররা।
Advertisement
তাদের এ বর্বর গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ড যারা সরাসরি দেখেছেন, সে রাতের ভয়াবহতায় আজও শিউরে ওঠেন তারা।
২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতের অন্যতম সাক্ষী হলেন বগুড়ার হায়দার আলী। তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন স্কুল ও কলেজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি।
হায়দার আলী জানান, অপরিণত হাতের তোলা একটি ভিডিও চিত্র ’৭১’র ২৫ মার্চের ভয়াবহতার অন্যতম দলিল। পরদিন সকালে তোলা অস্পষ্ট এই ভিডিওতে দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জগন্নাথ হলের ছাত্রদের দিয়ে অন্য ছাত্রদের মরদেহ সরাচ্ছে। তার আগে ওই ছাত্রদেরও সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়।
Advertisement
বগুড়ার সেই রাতের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ২৫ মার্চে কালরাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে আছে। বগুড়া থানার তৎকালীন ওসি ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সোর্স মারফত তিনি জানতে পারেন, একদল পাকিস্তানি সৈন্য রংপুর থেকে রওনা হয়েছে। রাতের মধ্যে শেষ করে দেবে বগুড়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনা। হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সব জেলায় একসঙ্গে অপারেশন চালানো হবে।
এ খবর পাওয়া মাত্র তিনি দেরি না করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা প্রচার করলেন, ‘জাগো জাগো বগুড়াবাসী। রংপুর থেকে আর্মি রওনা দিয়েছে। রাস্তায় ব্যারিকেড লাগাও, প্রতিরোধ কর। জাগো জাগো।’
বগুড়া শহরে প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় গাড়ি নিয়ে প্রচার করলেন ওসি এই তথ্য। এরপর কালীতলা এলাকায় তিনিসহ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মমতাজ উদ্দিন, একে মজিবর রহমান, মোশারফ হোসেন মণ্ডল, লাল ভাই, তপন, স্বপন, ডা. জাহিদুর রহমানের সঙ্গে দেখা করলেন ওসি সাহেব। খুলে বললেন সব ঘটনা। আশ্বাস দিলেন এই বলে, আপনারা প্রতিরোধ করুন, পুলিশ আপনাদের পাশে থাকবে।
ওসির সেদিনের প্রচারণা কাজে আসলো। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। এরই মাঝে সমস্ত শহরে রাতের অন্ধকার চিরে স্লোগান ভেসে উঠল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
Advertisement
সাইরেন বেজে উঠল কালিতলা মসজিদ থেকে। এরপর রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চোখের পলকে নিমিশের মধ্যে সমস্ত বগুড়া শহর মিছিলে মিছিলে আর স্লোগানে কেঁপে উঠল। সবাই মিলে রংপুর রোডে গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের আর্মিরা ধীরে ধীরে দানবের মতো এগিয়ে আসছে বগুড়া শহরের দিকে। পাকিস্তানি আর্মিদের জিপগুলো এসে যখন শহরের বাইরে থামলো, দেখলো রাস্তা বড় বড় গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা।
পাকিস্তানের সৈন্যরা ব্যারিকেড সরালো এবং মোকামতলার দিকে রওনা হলো। ঠেঙ্গামারার দিকে এসে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি থামল। পাকিস্তানি মেজর ইশারা দেয়ার সঙ্গে সবাই দ্রুত পজিশন নিল। তারপর বলল ফায়ার।
প্রথমে বুকে গুলি খেয়ে পাখির মতো গাছ থেকে ঢলে পড়ল ঠেঙ্গামারার ট্রাক ড্রাইভার তোতা। এই তোতাই বগুড়ার প্রথম শহীদ।
হায়দার আলী বলেন, আমরা পরে জানতে পারি, রাত ১২টার পর রংপুরে পাকিস্তানি বাহিনী রংপুরস্থ ইপিআর ও নিরস্ত্র জনতার ওপর বেপরোয়াভাবে গোলাবর্ষণ করছে। সেখানে সারা রাত গোলাগুলি চলে।
এ রাতে সেনাবহিনীর বেশ কিছু হতাহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল রাজশাহী ও বগুড়া সেনানিবাস থেকে বের হয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাতভর রাজশাহী ও বগুড়ার পুরো জেলায় টহল দিয়ে শেষরাতে তারা সেনানিবাসে ফিরে যায়।
এদিন পুলিশ, ছাত্র-জনতা মিলে শহরের বিভিন্ন রাস্থায় ব্যারিকেড দিতে থাকে। ইপিআর সৈনিকরাও বেসামরিক পোশাকে তাদের সাহায্য করেছিল।
সন্ধ্যায় কয়েকটি পাকিস্তানি সেনাভর্তি গাড়ি শহরের পুলিশ লাইনের পাশে গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত ছিল এবং তারাও পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করে। অবস্থার বেগতিক দেখে পাকিস্তানি বাহিনী রাতে আর অগ্রসর না হয়ে সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে। তবে রাজশাহী ও বগুড়ায় এই রাতে তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি।
লিমন বাসার/এএম/আরআইপি