ফিচার

পুলিশ জাদুঘর : মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাসের ভাণ্ডার

বাইরে থেকে ভবনটি দেখতে নান্দনিক। আর ভেতরে যাওয়া মাত্রই ভবনজুড়ে সাজিয়ে রাখা দুর্লভ সব আলোকচিত্র ও স্মারক যে কাউকেই শিহরিত করে তুলবে।

Advertisement

ছিমছাম করে সাজানো গৌরবের নানান উজ্জ্বল স্মারক। দেয়ালজুড়ে সব দুর্লভ আলোকচিত্র। যা দেখে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মস্তক, শরীরে জাগে অভূতপূর্ব উন্মাদনা।

দেয়ালের একেকটা ছবি, কাঁচে ঘিরে রাখা স্মারক মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা, হত্যা, নির্যাতনের কথা। মৃদু শব্দে অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার থেকে ভেসে আসা স্বাধীনতার বিভিন্ন গান রক্তে নাচন তোলে।

পুরো ভবনের সব স্মারক, আলোকচিত্র দেখেও শেষ হয় না দর্শনার্থীদের আগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধকে জানার ইচ্ছা। বিশেষ করে শিশু-কিশোর আর তরুণদের জানার আগ্রহ বেশি।

Advertisement

রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ অডিটরিয়াম ভবনের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে `বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর`। জাদুঘরে সংরক্ষণ করা প্রত্যেকটি স্মারক সাক্ষ্য দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা সব কাহিনী। গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার ইতিহাস যেন এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

শুক্রবার বিকেলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রাঙ্গণে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন ও স্বাধীনতা প্রথম প্রহর পালন-২০১৭ উপলক্ষে বইমেলায় ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানর আয়োজন করা হয়।

এ অনুষ্ঠানে আসা দর্শনার্থীদের পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এদিন মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যসহ অন্যান্য শহীদ পরিবারের সদস্যদের অনেকেই আসেন পুলিশ জাদুঘরে।

আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন আইজি আব্দুল খালেকের স্ত্রী সেলিনা হোসেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাগলা ঘণ্টা বাজানো পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলী।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু গ্যালারি দিয়ে শুরু হওয়া পুলিশ জাদুঘরের গ্যালারি দুর্লভ সব ছবি আর পোস্টারে পরিপাটি করে সাজানো।

জাদুঘরের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবরার হোসেনের চোখ আটকে যায় সেই পাগলা ঘণ্টায়। কেন এটা পাগলা ঘণ্টা, কে বাজিয়েছিলেন এ ঘণ্টা? কেনই বা বাজাতে হলো- প্রশ্নের শেষ নেই আবরারের। খুদে এই প্রশ্নকর্তার একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের।

আবরার পরে এ প্রতিবেদককে জানায়, ২৫ মার্চের কালোরাতে পাগলা ঘণ্টার শব্দেই স্বাধীনতার জন্য প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ সদস্যরা।

জাদুঘরে ঘোরার একপর্যায়ে সেই পাগলা ঘণ্টা বাজানো পুলিশ কনস্টেবল মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলীর সঙ্গ পেয়েই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে শিশুরা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর, ১৯৭৫ সালে পুলিশ সপ্তাহে দেয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন  একাদশ শ্রেণির ছাত্র মেহরাব। মুখেও আওড়াতে শুরু করেন তিনি। পরে বলেন, ৭ মার্চের স্বাধীনতার ভাষণ শুনলে তার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

জাদুঘরের নিচের (ভূগর্ভ) তলার গ্যালারি মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। `লেটার ডিস্ট্রিবিউশন বক্স`, পাগলা ঘণ্টা, পুলিশের পোশাক, প্রথম আইজির ব্যবহৃত সব পোশাক, পুলিশের ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়ি যা স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, দেয়ালজুড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়া শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, ইউনিফর্ম, চশমা, মানিব্যাগ ও সার্চলাইট।

জাদুঘরে দায়িত্ব পালনকারী সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, এখানে আজ নানা শ্রেণির দর্শনার্থী এসেছেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইমেলা থাকায় শিশু কিশোরদের আগ্রহ আজ বেশি।

এদিকে, জাদুঘর পরিদর্শন শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে জানতে চান, এ জাদুঘরে স্বাধীনতাযুদ্ধে সব পুলিশ সদস্যের আত্মত্যাগের বিষয়টি উঠে এসেছে কিনা? জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, চেষ্টা স্বত্ত্বেও তা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে স্বাধীনতার এতদিন পরে হলেও যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাপরিপূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

পরে মন্ত্রী বলেন, আর কেউ পুলিশের ভূমিকাকে খাটো করে দেখতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধটা পুলিশেই শুরু করেছিল এই রাজারবাগে। আজ সেখানে স্মৃতির এ সমারোহ দেখে শিক্ষার্থীরা আরও শিখবে, জানবে আমাদের গৌরবের ইতিহাস। গড়বে সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

বুধবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ৬ দিনই খোলা থাকে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকলেও দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত থাকে এক ঘণ্টার বিরতি। সবার জন্য উন্মুক্ত এই জাদুঘরে প্রবেশ টিকিটের মূল্য ১০ টাকা।

জেইউ/এসআর/এমএস