বিশেষ প্রতিবেদন

অপারেশন ‘সার্চলাইট’ ও পেছনের কথা

১৯৭১সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত গণহত্যা। এ গণহত্যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল।

Advertisement

পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত ‘অপারেশন ব্লিটজ’র পরবর্তী অণুষঙ্গ। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাঙালিরা তখন পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল। মে’র মাঝামাঝি সময় সকল বড় বড় শহরের পতন ঘটার মধ্য দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান অংশ শেষ হয়। এ সামরিক আক্রমণ ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ত্বরান্বিত করে।

ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কূটনৈতিকগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই সময়ের ব্যাপক গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক R.J. Rummel লেখেন-

These “willing executioners” were fueled by an abiding anti-Bengali racism, especially against the Hindu minority. Bengalis were often compared with monkeys and chicken…And the soldiers were free to kill at will.

Advertisement

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ড্যান কগিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক, একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে উদ্ধৃত করেন এভাবে-“We can kill anyone for anything. We are accountable to no one.”

বিশ্বখ্যাত এ পত্রিকার একটি সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়-“It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland.”

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর ম্যালকম ডাবিস্নও ব্রাউনি তার ‘Horrors of East Pakistan Turning Hope into Despair’ রিপোর্টে লেখেন-

One tale that is widely believed and seems to come from many different sources is that 563 women picked up by the army in March and April and held in military brothels are not being released because they are pregnant beyond the point at which abortions are possible…

Advertisement

ওই গণহত্যা বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে তোলে যে কারণে পাকিস্তান সেনবাহিনীর বাঙ্গালি সেনাপতি ও সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং বহু মানুষকে শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এ ভয়াবহ গণহত্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙালিরা দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়৤ পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড ‘মিত্র বাহিনী’র কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়৤

পেছনের কথা১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বাঙালিরা আশা করেছিল যে ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ৬ দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খান পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি) এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে জাতীয় বিধানসভার কার্যাবলি মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন।

এ স্থগিতকরণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ একটি গণসমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশ এতই সফল ছিল যে পাকিস্তান সরকার সেনাছাউনি ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়।

ওই সময় সধারণ জনগণ ও সেনাবাহিনী এবং বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যাকার সংঘর্ষ ছিল প্রতিদিনকার ঘটনা। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকের উদ্দেশ্যে মার্চের মাঝামাঝি সময় ঢাকা আসেন এবং এরপর ভুট্টো তার সাথে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা না হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে (পশ্চিম পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর ভয় ছিল যে ক্ষমতা পূর্বে হস্তান্তরিত হলে পশ্চিমে পাকিস্তান পিপলস পার্টির কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে) পাকিস্তানি জেনারেলরা, (যাদের মধ্যে গুল হাসান ছিলেন অগ্রগামী) পিপিপি’কে সমর্থন যোগাতে থাকেন যার ফলাফল দাঁড়ায় সেনা আক্রমণ।

১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অণুযায়ী, পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েতা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়।

পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের আগে তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠান হয়। মার্চের ১৭ তারিখ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনার দায়িত্ব দেন। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনাটি জেনারেল ফরমান নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের পাঁচ পাতা জুড়ে লিড পেন্সিল দিয়ে লিখে নেন।

জেনারেল ফরমান অপারেশনের সিদ্ধান্ত ও সাফল্যের শর্ত ইত্যাদির সীমা তৈরি করেন এবং জেনারেল খাদিম সেনাদলের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের উপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। এটা ধারণা করা হয় যে, বাঙালি সেনারা অপারেশনের শুরুর সময় বিদ্রোহ করবে, তাই পরিকল্পনাকারীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপকালে বাঙালি সৈন্যদের অপারেশনের পূর্বেই নীরস্ত্র করা এবং বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন।

‘অপারেশনের সবকিছুই নির্ধারিত হল’- হাতে লিখিত পরিকল্পনাটি ২০ মার্চে আবার জেনারেল হামিদ ও লে. জেনারেল টিক্কা পর্যালোচনা করেন। জেনারেল হামিদ তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নীরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলেও শুধুমাত্র ইপিআর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীদের নীরস্ত্র করার অনুমতি দেন। ইয়াহিয়া খান তার সাথে এক বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করেন। পুনর্নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকার কমান্ডারদের কাছে তা বিতরণ করা হয়।

অপারেশন শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা ও তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সবকিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।পরিকল্পনার গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ

পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারিদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অণুযায়ী, অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাসনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

তাদের উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হলো- সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করতে হবে; সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে; ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশি করতে হবে। এছাড়া সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফসহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে; সকল পূর্বপাকিস্তানী (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে; আওয়ামী লীগের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন; এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন।

পরিকল্পনায় পূর্বনির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। যদিও পরিকল্পনায় পূর্বপাকিস্তানকে দমন করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হয়নি, এটা ধারণা করা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার এবং বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীদের নীরস্ত্র করার পর সাধারণ জনগণকে ভয় দেখিয়ে এক সাপ্তাহের মধ্যে সামরিক শাষণের আওতাভুক্ত করা হবে।

লে. জেনারেল টিক্কা খান ওই সময় বলেন, ১০ এপ্রিলের পর আর কোনো বাধা-বিপত্তি থাকবে না।

এমএআর/আরএস