বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক মোটা দাগে রাজনীতি-নির্ভর। এটি দু’দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই রাজনীতি সম্প্রতি একটু বেশিই উস্কে উঠেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন আমদানী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-বিষয়ক মন্তব্যের পর থেকে। বিষয় দু’টি বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
Advertisement
প্রথমতঃ আমরা যদি চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের বিষয়টি দেখি তাহলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ চীন থেকে কিংবা তিম্বাক্তু থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করলেও কারো কিছু বলার থাকার কথা নয়। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতি বা ব্যবসাপাতি কখনও সরলরৈখিক নয়। নইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন চীন সফর করছেন তখন ঠিক চীনের নিকটতম প্রতিবেশি উত্তর কোরিয়া কেন রকেট ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের পরীক্ষা চালাবে? তার মানে হচ্ছে যে, সমরাস্ত্র ও তেল-বাণিজ্য বৈশ্বিক রাজনীতির একটি বিরাট অংশ।
কোন দেশ কার কাছ থেকে কী প্রয়োজনে সমরাস্ত্র আমদানি করবে তা কোনো দেশ এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে তখনই পারে যখন দেশটির নিজস্ব ক্ষমতা থাকে নিরঙ্কুশ। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং অধুনা ভারত। কিন্তু উত্তর কোরিয়া বা ইরান যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করুক না কেন তা নিয়ে বিশ্বময় প্রশ্ন উঠবেই, আলোচনা হবেই। সে কারণেই হয়তো বাংলাদেশের হঠাৎ সাবমেরিন ক্রয় নিয়ে এতো হৈ চৈ শুরু হয়েছে। যদিও যতোটা ওপর থেকে বোঝা যায় তাতে বাংলাদেশের এই সমরাস্ত্র ক্রয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য তার সমুদ্রসীমা রক্ষণাবেক্ষণ।
প্রায়শঃই গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমারের খটমট লেগেই থাকে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এই খটমটে আরো ব্যপ্তি যোগ করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয় খানিকটা হলেও বাংলাদেশে নৌবাহিনীকে স্বস্তি দিয়েছে। কারণ যেকোনো যুদ্ধাবস্থা মোকাবিলার প্রাথমিক ধকল তো তাদেরকেই সামলাতে হবে। কিন্তু এতে কি ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ রয়েছে? আমার মতো যে কেউই হয়তো ভাববেন, নাতো এতে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কি আছে? ভারততো বাংলাদেশের বন্ধু-রাষ্ট্র।
Advertisement
কিন্তু ভারতের উদ্বেগের কারণ আমার মনে হয়, এই সমুদ্রসীমায় চীনাদের উপস্থিতির সুযোগ তৈরি হওয়ার বিষয়টিই। সাবমেরিনকে লক্ষ্য করে এই উপস্থিতি নিশ্চিত হয় কিনা ভারত সেটি ভেবে থাকতে পারে। অত্যন্ত যৌক্তিকও সে ভাবনা। কারণ বঙ্গোপসাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি হয়তো এ অঞ্চলকে একটু হলেও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মতো এখানেও অদূর ভবিষ্যতে কোনো উত্তেজনার জন্ম হলেও হতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশ যদি দৃঢ়ভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করে তাহলে ভারতের ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ দেখি না। স্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সামরিক-অঙ্গণে চীনের তথা চীনে তৈরি অস্ত্রের উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই, যখন চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তখন থেকে। তারপর থেকে কোনো সরকারই বাংলাদেশের যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ে চীনের সুপ্রিমেসি একটুও কমাতে সমর্থ হয়নি। বরং বাংলাদেশের সামরিক চাহিদার কিয়দংশ এখন রাশিয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও তুরস্ক মেটালেও চীনকে টপকানো যায়নি এখনও অব্দি।
কিন্তু তাতে কি ভারতের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ ঘটেছে এতোকাল? ঘটেনি। তাহলে এখন কেন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে? বিশেষ করে সাবমেরিন ক্রয়ের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা বেশ তুঙ্গে পৌঁছেছে। মোদি সরকারকে দৃশ্য উস্কে দেওয়ার চেষ্টা এইসব প্রচারণা, সেটি এর প্রচার কৌশলই বলে দেয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশিসূলভ উদ্বেগের চেয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের উত্তেজনা কয়েক গুণ বেশি।
প্রশ্ন হলো, মিডিয়ার এই উত্তেজনা কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান উচ্চতাকে কোনোভাবে স্পর্শ করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের এরপরের প্রশ্নটি নিয়েও আলোচনা করতে হবে।
Advertisement
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন করে আলোচনায় এনেছে তাহলো হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর নামোচ্চারণ করে ২০০১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দলকে হারানোর অভিযোগ তুলেছেন। একথা এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না যে, শেখ হাসিনার মতো নেতা কোনো কিছু না ভেবেই এই অভিযোগ এনেছেন। বরং শেখ হাসিনা বিষয়টি অত্যন্ত ভালোভাবে বুঝে তবেই উচ্চারণ করেছেন এসব কথা। ভারতে তার রাষ্ট্রীয় সফরের আগে এই বক্তব্য একথাই প্রমাণ করে যে, তিনি আসলে জানেন যে, ভারতের রাজনৈতিক শক্তি নয়, ভারতের ব্যুরোক্রেসি আসলে কখনও কখনও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
বরং ভারতের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সে কংগ্রেস হোক, বিজেপি হোক কিংবা বামপন্থী রাজনৈতিক দল হোক, শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড় এবং সত্যিকার অর্থেই দ্বিপাক্ষিক চাওয়া ও পাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার বিশ্ব রাজনীতির সূত্র মতে।
কিংবা এও সত্য যে, রাজনৈতিক সরকারকে দিয়ে ব্যুরোক্রেসি বা গোয়েন্দা সংস্থা জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ-বিরোধী কাজও করিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক সম্প্রতি তার একটি লেখায় বিষদ উল্লেখ করেছেন কী করে ২০০১ সালের নির্বাচনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করেছিল। নির্বাচনের আগে তারেক জিয়া যে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকুক না কেন নির্বাচনের পরে তারা আসলে কী করেছিল তার প্রমাণ দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়া কিংবা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা।
সুতরাং, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ভারতকে তার স্বার্থ-বিরোধী কাজের উদাহরণ দেখিয়ে দিতেই পারেন এবং দেওয়া উচিতও। বিএনপি যতোই অস্বীকার করুক না কেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে তিনি একটি কঠিন কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর এর সঙ্গে জামায়াতকে যোগ করলেতো ভারত-বিরোধিতার সমীকরণটি পূর্ণতা লাভ করে।
এখন প্রশ্ন হলো এই দু’টি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে যারা একথা ভাবতে চাইছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের সমর্থন এখন বিএনপি’র দিকে ধাবিত হচ্ছে। একথা তারাই ভাবছেন যারা কংগ্রেসকে হারিয়ে মোদির নেতৃত্বে বিজেপির ক্ষমতা গ্রহণে এই ভেবে আনন্দ পেয়েছিলেন যে, এবার হয়তো শেখ হাসিনাকে ভারত সরিয়ে দিয়ে ম্যাডাম জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত কি এতোটাই বোকা যে, যার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা ক্রমশঃ তলানীর দিকে, যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জঙ্গিবাদকে আশ্রয় করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে, ভারতকে এক হাত না নিয়ে যে দলটির নেতাকর্মীরা এক বিন্দু জলও স্পর্শ করে না, তাদেরকে টেনে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে নরেন্দ্র মোদি বা তার দল এতোটা বোকা হলে নিশ্চয়ই আর ভারতের মতো এতোবড় একটি জটিল গণতন্ত্রের দেশে সরকার গঠন করতে সমর্থ হতেন না।
তার চেয়েও বড় কথা হলো, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের ওপর নির্দিষ্ট। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দেশটির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতকে যতোটুকুই দিতে সমর্থ হবে তা সর্বার্থে জেনুইন ও প্রশ্নের অতীত। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের জন্য যেকোনো প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটি ডেলিভার করতে যেমন ব্যর্থ হয়।
তেমনই প্রতিশ্রুতির বাইরে যা দেবে তা হবে ভারতের জন্য বিষবৎ বর্জনীয়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের মাটিকে ভারত-বিরোধী তৎপরতায় ব্যবহারের জন্য পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ও ভারদের নর্থ ইষ্ট অঙ্গরাজ্যসমূহের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদাহরণ টানা যেতে পারে। এরপরও ভারত তাদের সমর্থন দেবে কেন, সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই বিশ্লেষকদের মুখে।
লক্ষ্যণীয় যে, ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাত্রা একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সেই উচ্চতাটি আসলে কেমন? সেটি এমন যে, দু’দেশ এবং দু’দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় না দেয়া।
উদাহরণ দিয়ে নিবন্ধের আকার বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখছি না, তবে একথা বলতেই হবে যে, দু’টি দেশের ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়ন আগের চেয়ে যুগোপযোগী তো হয়েইছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে দু’দেশের জনগণকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের প্রয়োজনকে মাথায় রেখে পদক্ষেপ নেওয়া, যা অতীতে কখনওই দেখা যায়নি।
বরং আগে বাংলাদেশে একপক্ষ ভারত-বিরোধী রাজনীতি করলেও ভারতকে অনৈতিক সুবিধাদি দিতে কোনো কার্পণ্য দেখা যায়নি। আগেই বলেছি এই অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার আবরণে ঢেকে বাংলাদেশের মাটিকে উন্মুক্ত করা হয়েছে ভারত-বিরোধীদের জন্য। যার ফলে ভারতকে গুণতে হয়েছে বাংলাদেশ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তির লাভের তুলনায় বাংলাদেশের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা হুমকির জন্য অত্যন্ত চড়া মূল্য।
ভারতের জনগণ এই শুভঙ্করের ফাঁকটি ধরতে পেরেছে আর বাংলাদেশের জনগণ তো বুঝতেই পেরেছে যে, প্রতিবেশির সঙ্গে কোনো রকম ফাঁক রেখে সম্পর্ক করলে তা আসলে টেকে না।
বরং রাজনীতিকে পেছনে রেখে সম্পর্কের সূত্রটি খোঁজা উচিত পারস্পরিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। যে কারণে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি যেমন জরুরি, তেমন জরুরি ভারতের যে কোনো কনসার্নকে (বিশেষ করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত) বিবেচনায় নেওয়া। আবার ভারতেরও উচিত বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয় তেমন কোনো প্রকল্প থেকে সরে আসা (নদী প্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া বা আন্তঃসংযোগ-প্রকল্প) বা অবিলম্বে তিস্তা চুক্তিটি সম্পন্ন করা। এবং প্রয়োজনে দু’ই দেশের মধ্যে যদি নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কোনো সমঝোতোরও প্রয়োজন হয় তাহলে সেটিও করা উচিত দু’দেশের জনগণের প্রয়োজন, নিরাপত্তা ও স্বার্থকে সমুন্নত রেখেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে যে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল তা কোনোভাবেই যেন নষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় পক্ষকেই সর্বাত্মক চেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। দু’পক্ষকেই মনে রাখতে হবে যে, বন্ধুত্বে ছোট বা বড় কোনো ইস্যু নয়, নয় শক্তি প্রদর্শনের কোনো নিয়ামক, সবচেয়ে বড় কথা হলো দুই দেশের বন্ধুত্বের মধ্যে রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া কোনোভাবেই সমীচিন হবে না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর