বিশেষ প্রতিবেদন

‘আমরা গড়তাছি, আর আগুনে পুড়তাছে’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও অধিকাংশ মানুষের মুখে খাবার জোটেনি। পুড়ে যাওয়া দোকান ও ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবশিষ্ট জিনিসপত্র উদ্ধারে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্তরা। কেউ কেউ নতুন কাঠ ও বাঁশ এনে ঘর মেরামতের চেষ্টা করছেন। কেউবা শুয়ে রাতের সেই অগ্নিকাণ্ডকে এখনও দুঃস্বপ্নই ভাবছেন।হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকারে ভেঙেছিল রাজধানীর গুলশানের কড়াইল বস্তির মধ্য রাতের নীরবতা। গত বুধবার রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও সাড়ে ৫ ঘণ্টা আগুনে তিলে তিলে গড়ে তোলা দোকানপাটসহ ২ হাজারের বেশি থাকার ঘর পুড়ে যায়।কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডকে ফায়ার সার্ভিস দুর্ঘটনা হিসেবে দেখলেও ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী বলছেন বারবার অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয় বরং পরিকল্পিত নাশকতা। শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বস্তির পোড়া ধ্বংসস্তূপে অনেকে নতুন করে বাঁচার চেষ্টায় ঘর নির্মাণ করছেন। নতুন কাঠ, বাঁশ দিয়ে কোনো রকম খুপড়ি বানিয়ে সেখানে রাত যাপন করছে অসংখ্য পরিবার। দিনে আবারও ঘর নির্মাণের চেষ্টা। অনেকে খুঁজে ফিরছেন শেষ সম্বল। ছাই ঘেঁটে খুঁজছেন টাকা, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন দামি জিনিসপত্রের ধ্বংসাবশেষ।বিলকিস বেগম জানান, মানিকগঞ্জে নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে ৩০ বছর আগে কড়াইল বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি। তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন দুটি দোকান। ইট সিমেন্টের দেয়াল দিয়ে গড়েছিলেন ঘর। এই বছরের দুইবারের আগুনে ক্ষতি না হলেও এবারের আগুনে সবই পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা গড়তাছি আর আগুনে পোড়তাছে। কোথায় যামু! হয় এখানে থাকার একটা বন্দোবস্ত করা হোক, নতুবা উচ্ছেদ কইরা পুনরায় রাস্তায় নামায় দিক। আর সহ্য হয় না।’সারাদিন খাবারের সন্ধান না করে নিজের ব্যবসা পুনরায় দাঁড় করানোর চিন্তায় বিভোর আব্দুর সাত্তার। সিটি কর্পোরেশনের সহায়তা না পেয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে জামাই-শ্বশুরের খাবার বন্দোবস্ত হয় শেষ বিকেলে। আব্দুস সাত্তার মিয়া বলেন, ‘টেইলার্সে কাপড় সেলাই করতাম। ভালোই যাচ্ছিল দিন। কিন্তু আগুন এভাবে সব শেষ করে দিতে পারে ভাবিনি।’মুদি দোকানের ব্যবসা ছিল সেলিম মিয়ার। আগুনে সব পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে তার স্বপ্নের দোকান। পোড়া দোকানের উপর দাঁড়িয়ে নিষ্ফল তাকিয়ে থাকা ছাড়া যেন কোনো উপায় মিলছে না সেলিম মিয়ার। তিনি বলেন, এক বছরে তিন বার আগুন লাগল। অর্জিত আয়ের সবটুকু অর্থে গড়ে তোলা মুদি দোকানে ২ সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে সংসারে ছিল না খাবারের চিন্তা। কিন্তু নিমিষেই যেন সব শেষ। স্ত্রী সন্তান না থাকলে আত্মহত্যাই হতো বুঝি বেঁচে যাওয়ার পথ। এখন কি করব তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।দুই দিন পর আজ দুপুরে কামাল মিয়ার সংসারে লাকড়ি জ্বলেছে। এক খাটে বসে ৬ জন মানুষের খানাপিনার জোগান চলছিল। কামাল মিয়ার স্ত্রী আসফিয়া কোলে শিশু সন্তান নিয়ে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। আসফিয়া বেগম বলেন, ‘গতকাল স্থানীয় কাউন্সিলর খাবারের বন্দোবস্ত করলেও আজ এখনও খাবার মেলেনি। তাই রান্না করে খাওনের আয়োজন।’ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রধান কার্যালয়ের ওয়্যার হাউস পরিদর্শক পলাশ চন্দ্র মোদক জানান, আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা চলছে। এখনও তা নির্ধারণ করা যায়নি। তবে কেউ নিহত হয়নি। অনেকে আহত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (উন্নয়ন) আব্দুল মান্নানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী চৌধুরী মো. ফাহিম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের মাঠ কর্মীরা এখানে কাজ করছে। জরিপ করা হয়েছে। কয়টি পরিবার কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, তা জরিপ শেষে আমরা অফিসে জমা দেব। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমাদের প্রকল্প রয়েছে। ব্র্যাক-ডিএনসিসির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে অনুদান দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।জেইউ/জেএইচ/ওআর/আরআইপি

Advertisement