মালয়েশিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় হয়ে পড়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। অবৈধ কর্মীদের বৈধ করতে মালয়েশিয়া সরকারের চালু করা বিশেষ প্রোগ্রাম ঘিরে গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের এ শক্তিশালী চক্র।
Advertisement
সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু রেখেছে। একটি রি-হিয়ারিং অন্যটি ই-কার্ড প্রোগ্রাম। এ দুটি প্রোগ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র।
অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করা ও মালিকের কাছে কাজ পাইয়ে দিতে সব জায়গাতেই এ চক্রকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের। কর্মীদের বৈধ করার নামে ৫ থেকে ১০ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি নিচ্ছে চক্রটি। যদিও বৈধ হতে রি-হিয়ারিং এ ১২শ’ রিঙ্গিত জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়।
আর বিনামূল্যের ই-কার্ড প্রোগ্রামও এক হাজার রিঙ্গিত জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। যদিও এর আওতায় অনেকেরই বৈধ হওয়ার সুযোগ নেই। সরকার কয়েকটি ক্রাইটেরিয়ার মাধ্যমে বৈধকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
Advertisement
সরেজমিনে ঘুরে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা রীতিমতো নিজেদের নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে প্রকাশ্যে এ ব্যবসা শুরু করছেন। বৈধ করে দেবার নাম করে বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীদের কাছে অর্থ নিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীদের বৈধ করতে পারেননি।
কিন্তু কর্মীদের অর্থ ফেরত দিচ্ছেন না তারা। উল্টো তাদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে এ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন অবৈধ কর্মীরা।
শ্রমিকরা জানান, এ সুযোগে মালিক অবৈধ শ্রমিকদের দিয়ে অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আর বৈধতার নামে অর্থ আদায় করছেন মধ্যস্বত্বভোগী বাংলাদেশিরা। ফলে হার ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পড়ে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। অনেকটাই মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
Advertisement
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি মিডলম্যান দেশটিতে কর্মী কিনছে আর বিক্রি করছে। তারা যে যেভাবে পারেন সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছেন। কখনও হাইকমিশনের নামে, কখনও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেওয়ার নামে; আবার কখনওবা বৈধ করে দেওয়ার নামে।
তিনি জানান, সাধারণ কর্মীরা বাধ্য হচ্ছে এ চক্রের কথা মতো চলতে। বৈধ হওয়ার আবেদন করতে সরকারিভাবে ১২শ’ রিঙ্গিত জমা দিতে হলেও, বাংলাদেশি শ্রমিকরা অনেকেই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিরাও বাংলাদেশেরই নাগরিক।তারাও একদিন কর্মী হিসেবেই মালয়েশিয়ায় গেছেন। দীর্ঘদিন দেশটিতে বসবাস করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি তাদের পুলিশের সঙ্গেও ভালো পরিচিতি রয়েছে।
মালয়েশিয়ার কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় থাকেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ইব্রাহিম মানিক। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষে বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে বসবাস করছেন দেশটিতে। ইব্রাহিম মানিক বৈধতা নিতে ভিসার জন্য পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে যোগাযোগ করেন টাঙ্গাইলের মাসুদের সঙ্গে। মাসুদও মালয়েশিয়ায় একই এলাকায় থাকেন দীর্ঘদিন ধরে।
শুক্রবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইব্রাহিম মানিক জানান, ভিসা করে দেওয়ার জন্য মাসুদকে দুই দফায় ১০ হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ টাকা) দিয়েছেন তিনি। ৫ হাজার দেন ২০১৫ সালের অক্টোবরে আর বাকি রিঙ্গিত গত বছর দেন তাকে।
ইব্রাহিম মানিকের অভিযোগ, এতো পরিমাণ টাকা দেয়া হলেও মাসুদ তাকে ভিসা করে দেননি। প্রথম দফায় পাসপোর্টে একটি ভিসা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অনলাইনে চেক করতে গেলে জানা যায় তা ভুয়া।
‘পরের বার আমার ছবির পরিবর্তে পাসপোর্টে অন্যের ছবিযুক্ত ভুয়া ভিসা লাগিয়ে দেন মাসুদ। প্রতারণার বিষয়টি জানতে চাইলে উল্টো জীবননাশের হুমকি দেন আমাকে,’ যোগ করেন ভাগ্য বিড়ম্বিত এ বাংলাদেশি।
মানিক বলেন, বর্তমানে তিনি একটি গ্লাস কোম্পানিতে কাজ করেন। অবৈধ হওয়ায় সচরাচর বাইরে বের হতে পারেন না। কাজ শেষ করে কক্ষেই থাকেন বেশির ভাগ।
সরেজমিনে কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় বাংলাদেশি কর্মীরা জানান, মাসুদ এক সময় কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় গেলেও বর্তমানে তিনি কোনো কাজ করেন না। ইব্রাহিম মানিকের মতো অনেক শ্রমিকের কাছ থেকে ভিসা করিয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন তিনি। ওই এলাকায় ভারতীয়দের সমন্বয়ে তার একটি গ্রুপ রয়েছে বলেও অভিযোগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মীরা বলেন, কর্মীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করাই ওই গ্রুপের কাজ। এছাড়া অবৈধ হুন্ডি ব্যবসাও রয়েছে তাদের। প্রবাসী কর্মীরা এদের মাধ্যমে নানাভাবে নির্যাতিত হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
জানা যায়, গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রি-হিয়ারিংয়ের (পুনরায় শুনানি) নামে অবৈধদের বৈধ হওয়ার ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া সরকার। এর আওতায় এক লাখ ৮৮ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক রেজিস্ট্রেশন করেন।
পরে মাত্র ১৮ হাজার বাংলাদেশি ভিসা পেয়েছেন। বাকি এক লাখ ৭০ হাজার অবৈধ শ্রমিক এখনও ভিসা পাননি। তবে এ রি-হিয়ারিং প্রোগ্রাম গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। কিন্তু পরে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈধ হওয়ার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে রি-হিয়ারিং প্রোগ্রামের পাশাপাশি চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা করে, অবৈধ শ্রমিকদের অস্থায়ী কাজের নিবন্ধন করতে হবে। এ নিবন্ধনের নাম দেয়া হয়েছে ই-কার্ড।
তবে অবৈধ অভিবাসীদের অভিযোগ, মালয়েশিয়া সরকার বৈধতার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েও ইমিগ্রেশন থেকে ভিসা দিতে পারছে না।
সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিদেশি কর্মী বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। দেশটিতে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ নেপালের, ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বাংলাদেশের, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মিয়ানমারের, ভারতের ৫ দশমিক ১ শতাংশ ।
এছাড়া ফিলিপাইনের ৩ দশমিক ১, ২ দশমিক ৫ শতাংশ পাকিস্তানের এবং থাইল্যান্ডের রয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য দেশের ৪ শতাংশ শ্রমিক কাজ করছেন মালয়েশিয়ায়।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দেন-দরবার করা হচ্ছে। বৈধ হওয়ার সময় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলেও দেশটিতে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চলছে প্রতিদিন। ‘প্রায়ই আটক করে কাউকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার অনেককে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ আগে ঘুষ খেত না। বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগীরাই তাদের ঘুষ খাওয়া শিখিয়েছেন,’ অভিযোগ করেন তিনি।
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর (শ্রমিক) সায়েদুল ইসলামও। তিনি জানান, আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দিতে। কিন্তু বৈধ হওয়ার আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। কারণ কেউ হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে চায় না।
এর একটা কারণ হিসেবে তিনি বলেন, হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে এমন ভয় থাকে অনেকের। অন্য কারণ হচ্ছে বৈধ করার নামে তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। সব কিছু তাদের উপর ছেড়ে দেন। পরে যখন সময় শেষ হওয়ার পথে তখন দেখেন মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের বৈধ করতে পারেনি।
‘কাজটা নিজের। এখানে কোনো মিডিলম্যান দিয়ে নিজের কাজ করা হবে না। কর্মীরা হাইকমিশনে এসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে আবেদন করবেন। তারপরই কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে বৈধ হবেন তারা,’ অবৈধ শ্রমিকদের পরামর্শ দিয়ে বলেন তিনি।
এসআর/এমএমএ/জেআইএম